Image description

বছর বদলালেও বদলায়নি রাজধানীর বায়ুদূষণের চিত্র। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে বায়ুদূষণ একের পর এক রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এবং চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বায়ুদূষণ ছিল ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপের কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে, বায়ুদূষণের লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না।

বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের বায়ুমান সূচকের (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই) উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুদূষণের এই চিত্র তুলে ধরেছে।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার নাউ -এর পর্যবেক্ষণ নিয়েছি। মূলত সেটার ভিত্তিতেই এই গবেষণা। স্থানভেদে ঢাকার বায়ুর মানমাত্রার পার্থক্য হতে পারে, তবে গবেষণায় আমরা গত নভেম্বর থেকেই বায়ুদূষণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করছি। গত ৯ বছরের ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি বায়ুদূষণের মধ্যে এবারই (২০২৪-২৫) আমরা সবচেয়ে বেশি দূষণ দেখছি। এটি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এ বছর জানুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের আট বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২৪.৫২ শতাংশ বেশি ছিল। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির বায়ুদূষণ আগের আট বছরের তুলনায় ১৪.৭৪ শতাংশ বেশি ছিল।

গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজধানীর বায়ুদূষণ জানুয়ারিতে ৫.৪১ ও ফেব্রুয়ারিতে ১.২১ শতাংশ বেশি ছিল। শুধু তা-ই নয়, ক্যাপসের হিসাবে গত ১১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ু ছিল ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের বায়ুমান সূচক আগের আট বছরের ডিসেম্বর মাসের গড়মানের তুলনায় ৩১.০৯ শতাংশ বেশি ছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বায়ুমান সূচক ২৬.৪৫ শতাংশ বেড়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনার পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ক্যাপস মূলত আমেরিকান দূতাবাসের একটা সেন্টারের উপাত্ত নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু ঢাকায় আরো সেন্টার আছে। সব মিলিয়ে গড় বলা উচিত। তবে বায়ুদূষণ বাড়ছে এটা সত্য।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, দেশের অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম, সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা, শিল্প-কারখানার উন্মুক্ত নিঃসরণ ও যানবাহনের ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, কঠিন বর্জ্য অব্যবস্থাপনা ও বায়োমাস পোড়ানো ইত্যাদি বায়ুদূষণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া আন্তঃসীমান্ত দূষণও দেশের বায়ুদূষণ অনেকাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীতে শীতকালে বা শুষ্ক মৌসুমের পাঁচ মাসে (নভেম্বর-মার্চ) সারা বছরের প্রায় ৫৭ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।

দুর্যোগপূর্ণ জানুয়ারির পর খুব অস্বাস্থ্যকর ফেব্রুয়ারি

বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে তা ভালো বা বিশুদ্ধ বাতাস। ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য। সূচক ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। ১৫১ থেকে ২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ বিবেচিত।

২০১৭ সালে ঢাকার ফেব্রুয়ারি মাসের বায়ুমান সূচক ছিল গড়ে ২২৭। ২০১৮ সালে ২২২, ২০১৯ সালে ২৩৬, ২০২০ সালে ২১৮, ২০২১ সালে ২৩৮, ২০২২ সালে ২০৮, ২০২৩ সালে ২২৫ ও ২০২৪ সালে ২৫৮ ছিল। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় বায়ুমান সূচক ২৬২-তে এসে দাঁড়িয়েছে, যা খুব অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে নির্দেশ করে। অর্থাত্ ৯ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি বায়ুদূষণের দিক থেকে প্রথম স্থানে অবস্থান করছে।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় গড় বায়ুমান সূচক ছিল ২৪০। ২০১৮ সালে ২৫৬, ২০১৯ সালে ২৪০, ২০২০ সালে ২৩৬, ২০২১ সালে ২৫৮, ২০২২ সালে ২২৮, ২০২৩ সালে ২৮৪ ও ২০২৪ সালে ৩০২ ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে গড় বায়ুমান সূচক ৩১৮-তে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাত্ ৯ বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস বায়ুদূষণের দিক থেকে প্রথম স্থানে অবস্থান করছে এবং এবারই প্রথম দুর্যোগপূর্ণ জানুয়ারি দেখা গেল। এ বছর  জানুয়ারি মাসের ৩১ দিনের মধ্যে ১৬ দিনই ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫ দিন ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ বায়ুমান।

এ ছাড়া ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের বায়ুমান সূচক ছিল ২৮৮, যা ৯ বছরের (২০১৬-২৪) ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৬ সালে ঢাকার ডিসেম্বর মাসের বায়ুমান সূচক ছিল ২২০। ২০১৭ সালে ২০৪, ২০১৮ সালে ২১১, ২০১৯ সালে ২০৫, ২০২০ সালে ২৩২, ২০২১ সালে ২০৭, ২০২২ সালে ২৪৯ ও ২০২৩ সালে ডিসেম্বরের গড় বায়ুমান ২২৮ ছিল।

লাগাম টানা যাচ্ছে না বায়ুদূষণের

রাজধানীর বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত হলেও কিছুতেই এর লাগাম টানা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বায়ুদূষণের উৎসগুলো খুব জটিল। এগুলো রাতারাতি বা একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একটা একটা করে কমিয়ে আনতে সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বায়ুদূষণের জন্য দায়ী কারণগুলো দিন দিন বাড়ছে। ফলে বায়ুদূষণও ঊর্ধ্বমুখী। এখন পর্যন্ত এমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি যার কারণে দূষণ কমতে পারে।

বায়ুদূষণের অনেক বিষয়ই নিয়ন্ত্রণে নেই বলে স্বীকার করে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনার পরিচালক  মো. জিয়াউল হক বলেন, দেশের বাইরে থেকে আসা ৩০ শতাংশ দূষণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বর্জ্য পোড়ানোর বিষয়টি আমরা বন্ধ করতে পারিনি। নির্মাণকাজে শৃঙ্খলা আনতে পারিনি। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজটায়ও সমন্বয়টাও করা যায়নি।

জিয়াউল হক বলেন, ঢাকা শহর ও দেশের অন্যান্য শহরে ফুটপাতের পাশের খোলা জায়গায় ব্যাপক বৃক্ষ রোপণ করা হবে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। কিছুটা ধীরগতিতে হলেও ইটের ভাটা থেকে পরিবেশবান্ধব ব্লকে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। সামনে আমরা শিল্প-কারখানায় সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্র (ক্যাপস) বসাব।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রীয় অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া ও ফুসফুসের রোগ, বন্ধ্যত্ব, ক্যান্সার এবং লিভার, কিডনি ও হার্টের সমস্যা হয়। পৃথিবীতে হার্ট অ্যাটাকের এক-চতর্থাংশই হয় দূষিত বায়ু সেবনের জন্য। বাইরে যাওয়ার আগে নাগরিকদের বায়ুর অবস্থা যাচাই করে মাস্ক পরে যাওয়া উচিত।