
তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গী শাখার বিজ্ঞান শাখার আলিম পরীক্ষার্থী মু. হাসিব। স্বপ্ন ছিল উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সরকারি কোনো মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের একটি গুলি শরীরে লাগলে মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় তার সেই স্বপ্ন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও এখনও তিনি শঙ্কামুক্ত নন। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা। সবাই যখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এই শিক্ষার্থী তখন ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। ফলে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন থাকলে এখন ভর্তি হতে চান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জানা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন মোড় নেয়। উত্তরার বি এন এস সেন্টারের সামনে ১৮ জুলাই বিকাল ৩টার দিকে এই বিপ্লবে যোগ দেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গী শাখার আলিম পরীক্ষার্থী মু. হাসিব। উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় থাকা এই তরুণ নিজের ক্যারিয়ারে কথা ভুলে দেশের আন্দোলনে শামিল হন।
সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তীব্র দমন-পীড়ন চালায়। বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে পুলিশের গুলি এসে সরাসরি হাসিবের গলার ডান পাশ দিয়ে বিদ্ধ হয়। মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহপাঠীরা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান, যেখানে তিনি ১৮-২২ জুলাই পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন।
জানা যায়, হাসপাতালে পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায়, হাসিবকে গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও তিনি নতুন এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। পুলিশ তাকে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে একাধিকবার হয়রানি করেন। আহত অবস্থায়ও তিনি তার বাসায় থাকতে পারেননি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, এক পর্যায়ে স্বৈরাচারের দোসররা তার বাবার একমাত্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা ছিল তাদের সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। ফলে হাসিবের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আত্মগোপনে থেকে গ্রাম্য ডাক্তারের মাধ্যমে গোপনে তার গুলিবিদ্ধ হাতের চিকিৎসা চালানো হয়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর হাসিবের বাবা আবুল বাশার ছেলের চিকিৎসার জন্য জুলাই স্মৃতি সংসদের সংশ্লিষ্টদের কাছে অর্থনৈতিক সহায়তার আবেদন করলে এক লক্ষ টাকা সহায়তা পান।
তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লব সফল হয়েছে, এতে আমি গর্বিত। কিন্তু আমার সন্তানের অবস্থা দেখলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। হাসিবের হাত এখনো পূর্ণ সুস্থ হয়নি, দীর্ঘসময় ধরে চিকিৎসা চালিয়ে নিতে হবে। ডাক্তার বলেছেন হাসিবের এই হাতে কখনো ভারি কাজ করতে পারবে না।
হাসিবের সহপাঠীরা বলছেন, তার গল্প শুধু একটি পরিবারের নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক প্রতিচ্ছবি। একজন তরুণ শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎ ভুলে গিয়ে দেশের জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু আজ সে নিজেই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। সরকারের উচিত এই তরুণ যোদ্ধার পাশে দাঁড়িয়ে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
জানতে চাইলে হাসিব বলেন, আলিম পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে জুলাই আন্দোলন শুরু হয় বিবেকের তাড়নায় বাসায় থাকতে না পেরে উত্তরায় আন্দোলনে যোগদান করি। এসময় সামনের দিকে থাকায় হঠাৎ একটা গুলি গলার ডান পাশ দিয়ে ঢুকে পেছনে দিকে বের হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে আল্লাহ আমি বেঁচে যাই।
‘‘পরে আমাকে উত্তরায় ক্রিসেন্ট হসপিটাল প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় পরে রাত ১টার দিকে পঙ্গু হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর দু’দিন পরে হসপিটাল থেকে পাঠিয়ে দেয় গ্রামে। সেখানে আসার পরে পুলিশ আমাকে খুঁজে আসে শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে। পরে নদীর পাড়ে আত্মীয়র বাড়ি আত্মগোপনে থাকি। এসময় গ্রাম্য ডাক্তার রাতে আসতো চিকিৎসা করার জন্য।’’
হাসিবের শরীরের সর্বশেষ অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, হাতের এখনও কোনো উন্নতি হয়নি। আমার চিকিৎসা শুধু থেরাপি কিন্তু এত মাস হয়ে গেছে এখনো কোন উন্নতি হয়নি। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার কিন্তু তা আর সম্ভব হল না। এখন উত্তরার বিজিএম ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চাচ্ছি।