
সারা দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে মশার উৎপাত। কয়েক মাস ধরে এমন উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। রাজধানীতে দিনের বেলায় কোনো রকমে টিকতে পারলেও সন্ধ্যা হওয়ার পরপর ঘরে-বাইরে মশার যন্ত্রণায় দাঁড়ানোই দায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আসন্ন গরমের মৌসুমে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মশা নিধন কার্যক্রমে ঢিলেমির কারণে সামনের দিনে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করছেন তাঁরা।
সারা দেশের মশকনিধন ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে কাজ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এডিস মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজে তা ধ্বংস করা ও এডিস মশা এবং ডেঙ্গুসংক্রান্ত জরিপে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে সহযোগিতা করার কাজ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। অন্যদিকে রোগী শনাক্ত, চিকিৎসা, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, এডিস ও
ডেঙ্গুবিষয়ক জরিপ, জিনোমিক সিকোয়েন্সিংয়ের কাজগুলো করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দুই বিভাগের কাজে রয়েছে নানা অসংগতি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে মশা নির্মূলে পদক্ষেপের ঘাটতি, রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। এখনো এডিস নির্মূলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার।
মশকনিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বছরে কমবেশি ২০০ কোটি টাকা বাজেট আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেন আজকের পত্রিকার বলেন, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশকনিধন কার্যক্রমের জন্য ব্যয় হয়েছে ৮৭ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১১১ কোটি টাকা।’ মশার নিধনে অনেকটা সমান অর্থ ব্যয় করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি)।
মশার পেছনে দুই সিটি করপোরেশনের এত বিপুল ব্যয়ের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
আগে শহরের মশকনিধন কার্যক্রম স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দেখভাল করতেন। গত ৫ আগস্টের পর সেই দায়িত্ব এসেছে একজন কর্মকর্তার ওপর। দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব দেখা গেছে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মধ্যেও।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মোট ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন ১০ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁদের অধীনে মশককর্মীরাও কাজ করেন। যদিও এ কাজটি আগে সরাসরি দেখভাল করতেন ৫৪টি ওয়ার্ডের একজন করে সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তাঁদের সঙ্গে আরও ১৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরও ছিলেন। ডিএনসিসি এলাকায় এসব জনপ্রতিনিধি মশকনিধন কার্যক্রমের তদারকি ছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি মনিটরিং করতেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কাউন্সিলরদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। বর্তমানে কয়েকটি ওয়ার্ডের সার্বিক কার্যক্রম দেখভাল করেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তার পক্ষে প্রশাসনিক কার্যক্রম শেষে মাঠপর্যায়ে গিয়ে মশকনিধন কার্যক্রম দেখভালের খুব একটা সুযোগ নেই। ফলে মশকনিধনে যে স্বল্পসংখ্যক কর্মী মাঠে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যেও গা-ছাড়া ভাব চলে এসেছে।
রাজধানীর আরেক অংশের দায়িত্বে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। আজিমপুর অফিসার্স কলোনির বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে মশার ব্যাপক উৎপাত। গত দুই মাসের মধ্যে কলোনির মধ্যে কোনো মশকনিধনকর্মীকে ওষুধ ছিটাতে দেখি নাই।’
নিউ ইস্কাটন এলাকার বসবাস করেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল হকও গতকাল কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মশারি টানানোর পরও মশার ভন ভন থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। রমজান শুরু হওয়ার পর যখন মশারি থেকে বের হয়ে রাতে সেহরি খেতে বসি, তখন দেখা দেয় বড় বিপত্তিটা। দল বেঁধে মশা চারদিক ঘিরে ধরে।’
তবে মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা মানতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ‘আমাদের ৭৫টি ওয়ার্ডে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হয়। পুরো ডিএসসিসির ১০টি অঞ্চলের আওতায় ৭৫টি ওয়ার্ডে আমাদের কর্মীরা কাজ করছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৩৫ জন জনবল রয়েছে। সেখানে সুপারভাইজার, স্বাস্থ্য পরিদর্শকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা তদারকি করে থাকেন। তবে এ মুহূর্তে শহরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে মশার উৎপাত কিছুটা বেড়েছে। সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
এডিস মশাবাহিত সংক্রামক ভাইরাসটিতে এখন সারা বছরই আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। নগর থেকে শুরু করে প্রান্তিক অঞ্চলেও সংক্রমণ ঘটছে দ্রুত। ফলে সারা বছরই এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বছরজুড়ে কার্যক্রম পরিচালনাকে জোর দেওয়ার কথা বলছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রমের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। তবে গত জুলাই থেকে ওপি চালু না থাকার কারণে কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সার্ভে থেকে শুরু করে সব কাজ করা হয় ওপির টাকায়। বর্তমানে ওপি চালু না থাকার কারণে ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সার্ভের কাজটি করছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। ওপি না থাকলে কীভাবে কার্যক্রম চলবে সে বিষয়ে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মোট দেড় সহস্রাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২ মার্চের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর তাদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জনের বিপরীতে মারা গেছে ৩ জন। মার্চে ১৯ জন আক্রান্ত হলেও কোনো মৃত্যু ঘটেনি।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর সর্বশেষ এডিসের জরিপে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটির ৫৬টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি। ‘মনসুন এডিস সার্ভে-২০২৪’-এর ফলাফলে বলা হয়, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বীকৃত এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়। রাজধানীর দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৬টি ওয়ার্ডেই ব্রুটো ইনডেক্স-২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
মূলত তহবিলের সংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. হালিমুর রশিদ বলেন, ‘আইইডিসিআর সার্ভে করে। তাদেরকে এর জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। ওরা এখন বর্ষা-পূর্ববর্তী এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ও প্রজনন নিয়ে সার্ভে করছে। ওপির তফসিলেই মূলত প্রশিক্ষণ, ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কীট বিতরণ, প্রয়োজনীয় ওষুধের কিছু অংশ দেওয়া হয়। সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সকল কাজ করা হয়। ওপি না থাকার কারণে এসব কাজ চলছে না।
মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট ও জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম সারোয়ার। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু বিবেচনা করলে ডেঙ্গুর বাহককে বিবেচনা করতে হবে। এডিস মশার জীবনচক্র শুধু মৌসুমি সময়ে সীমাবদ্ধ নয়। সারা বছরই তাদের জীবনচক্র চলে। ফলে বছরজুড়ে এডিস মশা নির্মূলে কাজ করতে হবে।