
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন নির্বাচনী জোট গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ একাধিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। এ বিষয়ে কোনো দলের নেতারাই পরিষ্কার বক্তব্য দিচ্ছেন না; বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী সব হবে বলে তাদের অভিমত। তারা বলছেন, ‘প্রকাশ্যে অনেক বক্তব্য দিলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ চলছে। নানা ইস্যুতে খণ্ডিতভাবে বা দলগতভাবেও আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে। রাজনীতিতে যেহেতু শেষ বলে কোনো কথা নেই, তাই জোট হতে পারে; আবার এনসিপি এককভাবেও সব আসনে প্রার্থী দিতে পারে। সবকিছু নির্ভর করবে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। এনসিপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন সব তথ্য পাওয়া গেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অগ্রভাগে থাকা একঝাঁক উদ্যমী তরুণ-তরুণীর নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। নতুন এ দলটিকে ঘিরে রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে। দলটি এমন এক সময় আত্মপ্রকাশ করেছে যখন আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অরাজনৈতিক সংগঠন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র ব্যানারে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল সব রাজনৈতিক দল, মত ও পথের মানুষের কাছাকাছি যাওয়া। সেইসঙ্গে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচনী জোট নিয়েও আলোচনা করেন তারা। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এনসিপি আত্মপ্রকাশ করে। দলটির আত্মপ্রকাশের পর রাজনীতিতে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ।
এনসিপি নেতারা জানান, তারা শুরুতেই শহীদ মিনারে যাওয়া, স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া, নিহত শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিল, আহতদের সুস্থতা কামনায় দোয়া, রমজানে ইফতার মাহফিল এসব সাধারণ কিছু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। ধীরে ধীরে কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো হবে। ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য যেহেতু নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে গিয়ে গণমানুষের পক্ষে কথা বলা; সেভাবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিভিন্ন সংসদীয় আসনভিত্তিক দলীয় নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নিজ এলাকায় কর্মসূচি পালন ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলের নেতারা সে লক্ষ্যে কাজ করছেন।
বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষিত হয়নি। ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানারকম পরিকল্পনা চলছে। নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেবে নাকি জোটবদ্ধভাবে দলগুলো অংশ নেবে সে নিয়েও চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও সবাই আগাম প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন। আগামী নির্বাচন ঘিরে বিভিন্নমুখী কর্মসূচি ও পদক্ষেপ নিচ্ছে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনে বিএনপির সঙ্গেও রাজনৈতিক বা নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে পারে নতুন দলটি। এর প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে। ওই সময় ছাত্রদের সংগঠন বিএনপির কাছে শতাধিক আসন চেয়েছিল। তবে বিএনপি থেকে শুরুতে ৫ থেকে ৭টি আসন ছাড়ার প্রস্তাব থাকলেও এখন দলটি এনসিপিকে জোটে নিতে ২০-২৫টির মতো আসন দিতে চায় বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সরাসরি তদারকি ও দেখভাল করছেন বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে রাজনীতিতে আলোচনা আছে যে, ছাত্র-জনতার নতুন দল গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা নিয়ে নতুন দল এনসিপিতে মতানৈক্য রয়েছে। দলের একটি অংশ জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দল এবং সমমনা আরও কিছু দল নিয়ে বড় জোট করতে আগ্রহী। তবে এনসিপির অন্য একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়তে আগ্রহী নয়; বরং তারা বিএনপি ও তাদের সমমনা দলের সঙ্গে থেকে জোটবদ্ধ নির্বাচনে আগ্রহী। আবার অন্য একটি অংশের মতো কারও সঙ্গে জোট না করে সব আসনে প্রার্থী দিয়ে এককভাবে নির্বাচন করা। এর মধ্যে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে মত বেশিরভাগ নেতার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য গতকাল সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এখন তারা কীভাবে এগোবে সেটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার।’ আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো যোগাযোগ হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনই কিছু বলার সময় হয়নি। সবকিছু সময়ই বলে দেবে। আর এমন কিছু হলে সবাই জেনে যাবে।’
এনসিপির একাধিক নেতা জানান, নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দল খুব শিগগির প্রতীক চূড়ান্ত করে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। নির্বাচন হতে এখনো অনেক দেরি। যখন নির্বাচন হবে তখন দেখা যাবে কে কোন জোটে যায়। সে সময় যে কারও সঙ্গেই জোট হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আলোড়ন সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করা নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজেদের সময়োপযোগী কর্মসূচির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া। অবশ্য নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে ছাত্রনেতারা। সেক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে চিন্তা করছে তারা।
নাগরিক কমিটি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দল ঘোষণার আগে ছাত্ররা গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলনসহ কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে চিন্তা করে। এ ছাড়া বিএনপি এবং জামায়াতের তরুণ নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। তবে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। তবে নির্বাচনী জোট হওয়ার সম্ভাবনা এখনো রয়েছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে যে, রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে এবং নির্বাচনে ভালো আসন পেতে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে এনসিপি। দল ঘোষণার আগে থেকেই তারা যোগাযোগ করছেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের বাসায় বৈঠক হয়েছে বলেও জানা যায়। সেখানে ছাত্ররা প্রায় শতাধিক আসন বিএনপিকে ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছিল। তবে বিএনপি তাতে সম্মতি দেয়নি। প্রয়োজনে ‘কিছু আসন’ ছাড়তে চায় তারা। এক্ষেত্রে বাদ সাধে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়ি; এমন একাধিক আসন নিয়ে। সেসব আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী থাকায় এনসিপি নেতাদের অন্য এলাকা থেকে নির্বাচন করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ছাত্রদের দল গঠনের আগে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘বিএনপি ও ছাত্রনেতারা নির্বাচনকেন্দ্রিক বৃহত্তর সমঝোতার বিষয়েও অনাগ্রহী নন। এর ধরন ও ফর্মুলা আলোচনাসাপেক্ষ।’
অন্যদিকে নতুন দলকে ঘিরে আরেকটি আলোচনা আছে সেটি হলো—‘বিএনপির সঙ্গে যদি কোনো ধরনের সমঝোতা না হয় সেক্ষেত্রে তারা জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলোকে নিয়ে বড় ধরনের জোট করে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। তবে তার আগে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি সামনে আসায় অনেকে বেঁকে বসেছেন। তা ছাড়া জামায়াতের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়।
নতুন রাজনৈতিক দল-এনসিপি আগামী নির্বাচনের বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’ আগামী নির্বাচনে এনসিপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কথা শোনা যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা এ বিষয়ে কথা বলছেন এর জবাবও তারাই ভালো বলতে পারবেন। কারণ যারা এ নিয়ে কথা বলেনি; তাদের পক্ষে তো উত্তর দেওয়া সমীচীন নয়।’ এনসিপি যদি জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়তে চায় তাহলে জামায়াত কী করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘শুধু ছাত্রদের দল এনসিপি কেন? ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা মাঠে ছিল জামায়াত সেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্যের জন্য প্রস্তুত আছে।’
এদিকে এনসিপির নেতারা বলছেন, ‘দল ঘোষণার পর পার্টিতে এসব বিষয়ে এখনো কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। নিজেদের দলকে শক্ত ভিত তৈরিতে কাজ করছেন তারা। বিশেষ করে গঠনতন্ত্র, দলীয় স্লোগান, ঘোষণাপত্র, সাংগঠনিক কাঠামো ও দলীয় প্রতীক নিয়ে কাজ করছেন তারা। কারও সঙ্গে জোট বা সমঝোতা নিয়ে এখনো কোনো ভাবনা নেই।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির-এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘কারও সঙ্গে সমঝোতা হবে কি হবে না, সে আলাপ এখনো হয়নি। দল ঘোষণার পর আমরা আপাতত আমাদের প্রাথমিক কাজগুলোর দিকে মনোনিবেশ করেছি। এ ছাড়া বিএনপি গতানুগতিক ধারায় নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়; অন্যদিকে আমরা চাই বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার, নির্বাচনের সংস্কার। তাদের সঙ্গে এ বিষয়েও আমাদের মতবিরোধ আছে।’
এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি কিংবা অন্য দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার যে বিষয়টি আসছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ ধরনের কোনো আলাপ-আলোচনা এখনো আমাদের পার্টিতে হয়নি।’
গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘ছাত্রদের দল ঘোষণার আগে আমরা, এবি পার্টিসহ কয়েকটা দল নিয়ে একক পার্টি করা যায় কি না সে চিন্তা ছিল। সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক জোট হতে পারে। তারা (এনসিপি) যদি বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে আমরা সেখানে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
নতুন দলের সঙ্গে একীভূত হওয়া কিংবা নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়ে নুরুল হক নুর কালবেলাকে বলেছিলেন, নতুন দলের সঙ্গে আমাদের একীভূত হওয়ার একটা আলোচনা ছিল। তবে বিএনপির সঙ্গেও তাদের আসন সমঝোতার বিষয়টি সামনে আসছে। তাই নতুন দলের সঙ্গে যাওয়ার এখন আর কোনো সম্ভাবনা নেই।’