
রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকাকে উত্তপ্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলতে মহাপরিকল্পনা ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী ডেভিলদের। এরই অংশ হিসাবে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বেপরোয়া হয়ে উঠে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং ও টাকার বিনিময়ে মিছিলে অংশ নেওয়া টোকাইদের কাজে লাগানো হয়। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ওই অপরাধীরা দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ নেমে পড়ে ডাকাতি-ছিনতাইয়ে। অপারেশন ডেভিল হান্টের মধ্যেও মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, রামপুরাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ফিল্মি স্টাইলে চলতে থাকে ধারাবাহিক অপরাধ। মূলত ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গোপন নির্দেশনা পেয়ে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী সক্রিয় হয়ে ওঠে। যার কয়েকটি ঘটনা সামনেও আসে। এর মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি অডিও বার্তাও রয়েছে। আত্মগোপনে থাকা জাহাঙ্গীরের অডিও বার্তায় শেখ হাসিনার নির্দেশে রাতের ঢাকাকে বিষিয়ে তোলার পরিকল্পনার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। এতে ঢাকার মানুষের রাতের ঘুম হারাম করার কথাও বলা হয়।
এ বাস্তবতায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুর্বৃত্তরা আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ঘটাতে পারে-এমনটি আঁচ করতে পেরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ২৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এক জরুরি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। সেসময় তিনি বলেন, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য আওয়ামী দোসররা ব্যাপক টাকা ছড়াচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার কোনোভাবেই তা হতে দেবে না। এর পরদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত কম্বাইন্ড অপারেশন শুরুর নির্দেশ দেন তিনি। কয়েকদিন ভোরের দিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই বিভিন্ন থানা ও চেকপোস্টের কার্যক্রম আকস্মিক পরিদর্শন শুরু করেন। এতে পুলিশের মাঝে সতর্কতা এবং সক্রিয়ভাবে অপরাধ নির্মূলে দায়িত্ব পালনের তাগিদ বাড়ে। পাশাপাশি জনপ্রতিরোধের কারণে ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের মাঝে দেখা দেয় আতঙ্ক। ডেভিল হান্টের পাশাপাশি কম্বাইন্ড অপারেশন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া সাইবার ওয়ার্ল্ডেও প্যাট্রোলিং করছে পুলিশ।
রোববার রাতে রামপুরা থানাধীন বনশ্রীতে বাসার কাছে ফিল্মি স্টাইলে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে এবং গুলি করে ১৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। একই রাতে মুগদা এলাকায় এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে ছিনতাই, মোহাম্মদপুরের দুটি স্থানে রিকশা আরোহীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মোহাম্মদপুর ও শংকর এলাকায় হানা দেয় ডাকাতদল। ডাকাতদের অবস্থান আঁচ করতে পেরে এলাকাবাসী মাইকিং করেন। আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে ওই রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে ঢাবিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরদিনও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। এমনকি মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও দেন। এরই মধ্যে গত সোমবার বিকালে কোর কমিটির জরুরি বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব, এটিইউ এবং সিটিটিসির সমন্বয়ে কম্বাইন্ড অপারেশনের নির্দেশ দেন। চারদিন ধরে ডেভিল হান্ট অপারেশনের পাশাপাশি রাজধানীতে চলছে কম্বাইন্ড অপারেশন। এছাড়া ২৪ ঘণ্টা ডিএমপির ৫০টি থানা এলাকায় ৫০০টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৬৫টি পুলিশি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশের টহল ও চেকপোস্টের পাশাপাশি রাজধানীর অপরাধপ্রবণ স্থানে সিটিটিসির ১৪টি, এটিইউর ১২টি এবং ডিএমপির সঙ্গে র্যাবের ১০টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। এদিকে ডিএমপির চেকপোস্টের সঙ্গে এপিবিএন-এর ২০টি চেকপোস্ট দায়িত্ব পালন করছে বিভিন্ন এলাকায়।
সাধারণত ভোরের দিকে রাজধানীর থানার ডিউটি এবং চেকপোস্টের ডিউটি ঢিলেঢালা থাকে। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি উত্তরণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই ভোরের দিকে থানার কার্যক্রম এবং চেকপোস্টের ডিউটি পরিদর্শনে নগরীতে বেরিয়ে পড়েন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভোরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মিরপুর, দারুসসালাম, আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানা আকস্মিক পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি থানার হাজতখানা, এমনকি চেকপোস্টও পরিদর্শন করেন। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, এর আগেও তিনি কাউকে না জানিয়ে ভোরে পুলিশের কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। দায়িত্বে অবহেলা পাওয়ায় গুলশান থানার এক এসআই ও এক কনস্টেবলকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন আকস্মিক পরিদর্শনে মাঠ পুলিশ অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইকারীদের ধাওয়া দিয়ে ধরে জনতা উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা, মুখে কালি মেখে এলাকা ঘুরানোসহ বিভিন্ন শাস্তি দিতে শুরু করে। ছিনতাইকারীকে পিটিয়ে হত্যার খবরও পাওয়া যায়। এ অবস্থায় অপরাধীদের মাঝে ভীতি দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং জনপ্রতিরোধের কারণে নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তি দেখা গেছে।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, কম্বাইন্ড অপারেশনে বুধবার রাত ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া এ অপারেশন শুরুর পর থেকে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত ১ হাজার ৩১ অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিনতাইকারী। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে সারা দেশে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ১১ হাজার ৯২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ৬ মিনিট ৯ সেকেন্ডের একটি অডিও বার্তায় ঢাকা ও এর আশপাশের জেলার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা এবং আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর গোমর ফাঁস হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমাদের কথা স্পষ্ট, যেই রাজধানীতে আমাদের মানুষ দিনে শান্তিপূর্ণভাবে ঘুরতে পারবে না, চলতে পারবে না। সেই রাজধানীর মানুষ রাতে ঘুমাতে পারবে না। আমাদের চূড়ান্ত ডিসিশন, যেই রাজধানীতে আমরা দিনে থাকতে পারব না, সেই রাজধানীর মানুষের ঘুম আল্লাহ দিবে না, আমরা সেইভাবে নিজেদের তৈরি করে নিয়েছি। আমাদের ডিসিশন, যেভাবে আমাদের মূল নেত্রী আমাদের সাজেশন করবেন, আমরা পরামর্শক্রমে যেখানে যার সঙ্গে আলোচনা দরকার, সেটা করব। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা জেলা, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ আশপাশের বিভাগ, শহরের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সময়-পরিস্থিতিতে আমরা যা দরকার, তাই করব।’ জাহাঙ্গীরের এই ভিডিও বার্তায় আওয়ামী লীগ নেতারা যে অনলাইনে সংঘটিত হচ্ছেন, তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এছাড়াও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ তার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ, টেলিগ্রাম চ্যানেলসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে নানাবিধ পোস্ট আর ভিডিও বার্তা অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন মামলায় পলাতক বিভিন্ন নেতা অনলাইনে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। ইতঃপূর্বে ১৯ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের দাবিতে ফেব্রুয়ারিতে বড় কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ কর্মসূচি এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারেননি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী। কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ শেখ হাসিনার নির্দেশে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বাড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পনা করা হয়। আর এরই অংশ হিসাবে পাড়া-মহল্লায় ছিনতাই কাজে লেলিয়ে দেওয়া হয় কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীদের। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সরকার কঠোর হওয়ায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মহাপরিকল্পনা এ দফায় ভেস্তে যায়।
তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ছিনতাই কিছুটা কমেছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন খোঁজ নিয়ে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। একাধিক পুলিশ সদস্য শুক্রবার যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ভোরের দিকে আগে চেকপোস্টগুলোর কার্যক্রম কিছুটা ঢিলেঢালা থাকত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আকস্মিক পরিদর্শনের খবর প্রচার হওয়ার পর থেকে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে সবাই অ্যালার্ট থাকছেন। থানায়ও সতর্কতার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন এলাকার নাগরিকরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং জনগণের প্রতিরোধে অপরাধীদের তৎপরতা অনেকটা কমেছে। মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা কাউসার রহমান বলেন, জনগণ সোচ্চার হওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় একটু হলেও আইনশৃঙ্খলা উন্নতি হয়েছে। এভাবে আমাদের একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য : শুক্রবার রাতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, আইনশৃঙ্খলার সর্বাত্মক উন্নতি করতে পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, নগরী কিংবা দেশকে অস্থিতিশীল করতে কেউ ভার্চুয়াল প্রচেষ্টা করছে কি না, তা নজরদারি করতে সাইবার ওয়ার্ল্ডেও পুলিশের প্যাট্রোলিং অব্যাহত আছে।