Image description
পরিবহন খাতের মাফিয়া খন্দকার এনায়েত

দেশ ছাড়ার পাঁচ মাস পর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুনানি শেষে গতকাল বুধবার নির্দেশনা দেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা নিয়ে গতকাল বুধবার এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে মর্মে জানা গেছে। দুদকের পক্ষে সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম এ নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন।

খন্দকার এনায়েত উল্লাহ একাধারে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ নেতা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা সড়ক পরিবহন সেক্টর। দলীয় তহবিলে ‘ভোগ’ দিয়ে নিজে দু’হাতে লুটেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে অনুসন্ধান শুরু করলেও সংস্থাটির একজন মহাপরিচালকের (বর্তমানে অবসরে) সহযোগিতায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয় অনুসন্ধানটি। ৫ আগস্ট পরবর্তী সরকারের আমলে অনুসন্ধানটি পুনরায় সক্রিয় হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এনায়েত উল্লাহর নামে-বেনামে, স্ত্রী-সন্তানদের অবৈধ সম্পদ নতুন করে অনুসন্ধানে নামে দুদক। বর্তমান পর্যায়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, পুত্র রিদওয়ানুল আশিক নিলয় ও কন্যা চাশমে জাহান নিশির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। আবেদনের শুনানি শেষে গতকাল বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেনের (গালিব) আদালত দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের নির্দেশ দেন।

অনুসন্ধানকারী টিমের সদস্য দুদকের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। এতে বলা হয়, এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস থেকে দৈনিক এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করার অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন। অভিযোগ অনুসন্ধানকালে এনায়েত উল্লাহ তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে অবৈধ আয়ে নিজ এলাকায় কৃষিজমি, ফ্ল্যাট, প্লট ক্রয় এবং তাদের নামে বিপুল পরিমাণ অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। অপরাধলব্ধ অর্থ পাচার করে বিদেশে গড়ে তুলেছেন ‘সেকেন্ড হোম’। বর্তমানে সেই সেকেন্ড হোমে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস করছেন।

এনায়েত উল্লাহ, নার্গিস সামসাদ, পুত্র রিদওয়ানুল আশিক নিলয় ও মেয়ে চাশমে জাহান নিশি এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি হস্তান্তর করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। তারা বিদেশে পালিয়ে গেলে অনুসন্ধান কার্যক্রম দীর্ঘায়িত বা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।

এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ প্রতিবেদককে জানান, শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর গত মধ্য সেপ্টেম্বর সপরিবারে দেশ ত্যাগ করেন এনায়েত উল্লাহ খন্দকার। চিকিৎসা ভিসায় তারা থাইল্যান্ডের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। পরে তিনি আর দেশে ফিরেছন বলে জানা যায়নি।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ছিলেন পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া। রাজধানীসহ সারা দেশে ১৬ বছরে তিনি অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। হাসিনার দেড় দশক জুড়ে তিনি পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির এ নৈরাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। পরিবহন মালিক সমিতি ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের সরকারি নথিপত্রেই রয়েছে তার এ অর্থের হিসাব। পদাধিকার বলে চাঁদার ভাগ পেতেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের, শ্রমিক ও মালিক নেতা, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি অন্যান্য দফতরের কর্মকর্তাসহ ২১ জনের একটি চক্র।

পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়, দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির ৯২ শতাংশ মালিকই রাজনীতিবিদ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যখন যারা ক্ষমতায় থাকে ওই সব দলের সমর্থনপুষ্ট। জানা যায়, চাঁদাবাজি না থাকলে যাত্রীদের ৬০ শতাংশ ভাড়া কমে যেত।