Image description

Tuhin Khan(তুহিন খান)

৫ আগস্টের পর তখনকার ‘আশু করণীয়’ হিশাবে আমি যা যা লেখছিলাম, তার মধ্যে একটা ছিল ‘জেনারেল ওয়াকারের পদত্যাগ’। সে-সময়ের বাস্তবতা বুঝেই এই দাবি করছিলাম। অনেকেই এই দাবির বিপরীতে ছিলেন তখন। আবার অনেকে পক্ষ ছিলেন। ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ আমাকে তখন জানাইছিলেন যে, জেনারেল ওয়াকারের পদত্যাগের কোনো বাস্তবতা এই মুহূর্তে নাই। এক ছাত্রনেতার ভাষায়: ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে গণ-অভ্যুত্থান হইছে, তার চাইতে ৩ গুণ শক্তিশালী গণ-অভ্যুত্থান লাগবে এসব গোল অ্যাচিভ করতে গেলে। আর উই রেডি ফর দ্যাট? উই আর নট রেডি।’
সেই সময় পার হয়ে গেছে। জেনারেল ওয়াকারের পদত্যাগের কোনো বাস্তবতা আজ আর অবশিষ্ট নাই। কিন্তু জেনারেল ওয়াকার ও আর্মি আল্টিমেটলি কী চাচ্ছে, তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
জেনারেল ওয়াকারের আজকের বক্তব্য খুব স্পষ্ট ও চাঁচাছোলা। কোনো রাখঢাক করেন নাই তিনি। তার আজকের বক্তব্যের কী পয়েন্টস ৪ টা:
 
১. পুলিশ, র্যাব, এনএসআই, ডিজিএফআই— এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে তোলা যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের বিচার প্রশ্নটা এদের দুর্বল না করেই সলভ করা লাগবে। আর্মি যে এমন একটা পজিশন নেবে, ইউএনের রিপোর্টে আর্মির অবস্থান সংক্রান্ত একটা লেখায় আমি এর পূর্বাভাস দিছিলাম।
 
২. নির্বাচন ডিসেম্বরেই হইতে হবে এবং ‘ইনক্লুসিভ’ হইতে হবে।
 
৩. বিডিআর বিদ্রোহের বিচার পুরানা রীতিতে চলবে। নতুন কেউ জড়িত থাকলে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
 
৪. দেশব্যাপী যে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি এসব বন্ধ করা লাগবে। তথা, নানাবিধ ‘মব’ বন্ধ করা লাগবে, নতুবা ‘মব’র খেলা আরো বাড়বে।
সেনাপ্রধানের এসব আলাপে মোটাদাগে কোনো সমস্যা নাই। সবগুলাই ভালো কথা। কিন্তু এসব কথার সার কী? সার হইল, এই সরকারকে দ্রুত বিদায় নেওয়া লাগবে। এবং অতি বিপ্লবী তৎপরতাগুলা বন্ধ করা লাগবে। সোজা কথায়, স্টাব্লিশমেন্ট ঠিক রাখা লাগবে। আওয়ামী লীগকেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। এবং লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধানের কোনো বক্তব্য নাই। বরং বেশি বাড়াবাড়ি করলে সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে পড়ার হুমকি আছে।
সেনাপ্রধান এসব কথা কেন বলছেন, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। আগেও লেখছি, গুমঘর উন্মোচন, ইউএনের রিপোর্ট, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের আওয়াজ— এসবই খেপিয়ে তুলছে আর্মি স্টাব্লিশমেন্টরে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, চিফের কথায় বিএনপিপন্থীরা খুশি। আরবান মিডল ক্লাশ ও সাধারণ মানুশও বেশ খুশি। অথচ মাত্র ৫ মাস আগেও, সেনাপ্রধান এই ভাষায় কথা কইলে পাব্লিক তারে উদাম গালিগালাজ করত। এই যে ড্রাস্ট্রিক্যালি সিচুয়েশন চেঞ্জ হইল, কেন? এর কারণগুলা বোঝা লাগবে। নাইলে সামনের দিনে আমরা দেশগঠনে ইফেক্টিভলি আগাইতে পারব না:
 
১. লক্ষ্যভ্রষ্ট ও নেতৃত্বহীন অতি বিপ্লবী তৎপরতা
 
২. গঠনের সক্ষমতাহীন ভাঙনপ্রক্রিয়াকে উস্কে দেওয়া।
 
৩. আওয়ামী লীগের বিচার ও রিকনসিলিয়েশন প্রশ্নে লক্ষ্যহীনতা ও ঐক্যমত্যের অভাব।
 
৩. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক ব্যানারটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সুযোগসন্ধানীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়া।
 
৪. নানা ধরনের মতাদর্শিক বিভেদরে সামনে এনে, শাহবাগ-শাপলার চূড়ান্তরকম বিভাজনমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মতাদর্শিক রাজনীতির পালে হাওয়া দেওয়া।
 
৫. অভ্যুত্থানের পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপররে মাইনাস করার রাজনীতি শুরু করা।
 
৬. ভারতের সাথে ইফেক্টিভ কূটনীতির রূপরেখা তৈরি করতে না পারা।
 
৭. ছাত্রনেতৃত্বের সাথে মিলিটারি স্টাব্লিশমেন্টের আস্থার সম্পর্ক তৈরি হইতে না পারা। এর পেছনে নানা কারণ আছে, যেগুলা বিস্তারিত আলাপের অবকাশ নাই।
আর্মি এখন অনেক বোল্ড ও সরাসরি। সেটা আর্মির হইতেই হইত কোনো না কোনো সময়৷ দুর্ভাগ্য হইল, জনতার অনেক বড় একটা অংশও এখন আর্মির এসব বক্তব্যের সাথেই আছে। এই মুহূর্তে দেশের প্রধান দুইটা রাজনৈতিক দল আর্মির সাথে আছে। একটা দল তো তাদের ‘দেশপ্রেম’র সার্টিফিকেটও দিয়ে বেড়াইছে। ৫ আগস্টের পর রাজনীতিবিদরা যে জনগণের শক্তির বদলে মিলিটারি স্টাব্লিশমেন্টের শক্তির উপর ভর করলেন, এবং আল্টিমেটলি ৬ মাস পর জনতার একটা বড় ও ইফেক্টিভ অংশও নানা কারণে মিলিটারির সুর পছন্দ করতে শুরু করল, এই ঘটনায় এ দেশের ফিউচার রাজনীতিবিদ ও মুক্তিকামী মানুশের জন্য আছে প্রভূত শিক্ষা।
‘আর আমার কাজ তো শুধু পৌঁছে দেওয়া।’