
জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা, ভৌগোলিক ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য এবং যোগাযোগ সুবিধা দেখে সীমানা নির্ধারণ করা হবে। তবে ইউনিয়ন এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ওয়ার্ডকে কোনোভাবেই ভাগ করা হবে না।
জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইনের ৪, ৬ ও ৮ ধারায় অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা থাকার কথা জানিয়ে ওই ধারাগুলো সংশোধনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে সংশোধনী আইনের খসড়া পাঠিয়েছে কমিশন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২১ সালে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত আগের অধ্যাদেশ বাতিল করে নতুন আইন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার। এই আইন সংশোধনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি সংশোধিত খসড়াটি পর্যালোচনা করবে। এরপর সংযোজন-বিয়োজন শেষে তা পাসের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিলে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ জারি করা হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো প্রস্তাবে ইসি বলছে, বর্তমান আইনের ৪, ৬ ও ৮ ধারায় অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা থাকায় জনগণ এবং রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মনে সংশয় ও আপত্তি রয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এই সংশয়
ও আপত্তি দৃশ্যমান হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জাতীয় সংসদের বিদ্যমান সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আসতে থাকে।
ইসি সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৬৩টি নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য ৪০২টি আবেদন নির্বাচন কমিশনে জমা পড়েছে। আইন সংশোধন হওয়ার পর এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। ৬০টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হলে ১০০-এর বেশি আসনের সীমানা বদলে যাবে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না বলে আমরা আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছি। ৬২টি থেকে ৬৫টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের আবেদন পাওয়া গেছে। আইন সংশোধন হওয়ার পর এগুলো নিষ্পত্তি করা হবে।’
কী সংশোধন চায় ইসি
বর্তমান আইনের ৪ ধারায় বলা আছে—এই আইনের অধীন কমিশন তার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কোনো নির্বাচন কমিশনার বা তাঁর কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে।
এই ধারা বদলে ইসি প্রস্তাব করেছে, এই আইনের অধীন কমিশন তার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কোনো নির্বাচন কমিশনারকে প্রধান করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করবে। কমিটি প্রয়োজনবোধে কোনো ভূগোলবিদ, মানচিত্রকার, পরিসংখ্যানবিদ, জনসংখ্যাবিদ ও নগরপরিকল্পনাবিদকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
ইসি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বর্তমান আইনের ৬ ধারার বিধানমতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসংখ্যাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ায় দেশব্যাপী নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ শহর এলাকায় সংসদীয় আসনসংখ্যা বেড়েছে এবং গ্রাম এলাকায় আসনসংখ্যা কমেছে। এতে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ফলে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা এবং ভৌগোলিক অবস্থা ও অবস্থানকেও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বর্তমান আইনের ৬(২) ধারায় বলা আছে, কমিশন প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনা করে প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবে, যাতে প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় থাকে এবং এরূপ সীমানা নির্ধারণ সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদনে উল্লিখিত জনসংখ্যার যত দূর সম্ভব বাস্তব বণ্টনের ভিত্তিতে করতে হবে।
আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে ৬(২) ধারা পাল্টে দিয়ে সেখানে নতুন চারটি ক্লাস্টার যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে ইসি।
সেখানে বলা হয়েছে—(ক) প্রশাসনিক সুবিধা ও সীমানার অখণ্ডতা; নদী, পাহাড়ের অবস্থানসহ অন্যান্য ভৌগোলিক ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য এবং যোগাযোগ সুবিধা যত দূর সম্ভব বজায় রাখবে। (খ) যথাসম্ভব সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদন এবং সর্বশেষ হালনাগাদকৃত ভোটার সংখ্যা অনুসরণ করবে। (গ) পল্লি এলাকার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কোনোভাবেই বিভক্ত করবে না। (ঘ) পার্বত্য এলাকার তিন জেলাকে তিনটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা হিসেবে বিবেচনা করবে।
আগের অধ্যাদেশ বদলে নতুন আইন করে আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার আয়তন, অবস্থান হুবহু ঠিক রেখে শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলো অন্তর্ভুক্ত করে আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার তালিকা গেজেটে প্রকাশের ক্ষমতা ইসির হাতে রেখেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
এই নিয়ম সংশোধন করে দৈবদুর্বিপাক বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ না করে নির্বাচন করতে হলে, সেই নির্বাচন সর্বশেষ নির্ধারিত সীমানার ভিত্তিতে করতে হলে নির্বাচনী এলাকার আয়তন ও অবস্থান হুবহু ঠিক রেখে শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলো অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নিয়ম করা হচ্ছে। এই নিয়ম করা হলে ইসি নিজেদের মতো করে নির্বাচনী এলাকার আয়তন ও অবস্থান পাল্টে দিয়ে নিজেদের মতো করে সীমানা নির্ধারণ করতে পারবে।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের জন্য এ টি এম শামসুল হুদার কমিশন শতাধিক নির্বাচনী এলাকার সীমানায় পরিবর্তন আনে। এরপর কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ কমিশন দশম সংসদ নির্বাচনে ৫০টি আসনে ছোটখাটো পরিবর্তন আনে। কে এম নূরুল হুদা কমিশন ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২৫টি আসনে এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন ১২টি আসনের সীমানায় সামান্য পরিবর্তন আনে। তার আগে ১৯৮৪ ও ১৯৯১ সালে ৩৩টি নির্বাচনী এলাকার সীমানায় পরিবর্তন করা হয়।