
অবশেষে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়। বিমান টিকেটের সিন্ডিকেট ভাঙÍতে সরকার নতুন নিয়ম করেছে। এখন থেকে কোনো বিমান সংস্থা তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টার বেশি কোনো বিমান টিকিটের বুকিং রাখতে পারবে না। বুকিং দেওয়া টিকিট তিন দিনের মধ্যে যাত্রীর নামে ইস্যু করতে হবে। আর টিকিট বুকিংয়ের সংশ্লিষ্ট যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের ফটোকপিসহ বুকিং সম্পন্ন করতে হবে। তিন দিনের মধ্যে টিকিট ইস্যু করা না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুকিং দেওয়া ওই টিকিট বাতিল করতে হবে। অথচ এতোদিন ৩ মাস আগেই টিকিট সোল্ড আউট বা সিট খালি নেই দেখাতো। অনেকক্ষেত্রে ১০০ ডলারের টিকিট ৩০০ ডলারে বুকিং দিতে হতো। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে টিকেটের মজুতদারি সিন্ডিকেট বিদেশগামী সাধারণ মানুষকে হয়রাণি করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি করতো। টিকিটের দাম বাড়াতেই কৌশল করে গ্রুপের নামে টিকিট ব্লক করে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের সহায়তায় নিবন্ধনহীন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী টিকিট দেওয়ার নামে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এয়ার টিকিট বিক্রয়ের নামে শত শত কোটি টাকা অগ্রিম অর্থ সংগ্রহ করা হয়। যা মানুষের ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করছে। কারণ ভ্রমণ ব্যয় টিকেটেই চলে যাচ্ছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে ভ্রমণ গ্রুপের নামে টিকিট ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ, এটি কোনো গ্রুপ না। মূলত টিকিটের দাম বাড়াতেই কৌশলে এগুলো করা হচ্ছে। আবার অনেকে দেশে টিকেটের দাম বেশি হওয়ায় ভারত বা অন্যান্য দেশ থেকে টিকেট কাটছে। কারণ ওই সব দেশে বাংলাদেশ থেকে অর্ধেক দামে মিলে টিকেট। যা একরকম অর্থ পাচার। তারপরও অতিরিক্ত ব্যয় থেকে বাঁচতে অনেকেই এভাবে টিকেট কাটতে বাধ্য হতো।
আর তাই আকাশপথে ভ্রমণে বিমান টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে এই নির্দেশনা জারি করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এই নির্দেশনা জারি করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বিমান টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে মোট ১০টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোকে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় বলেছে, নতুন এই নির্দেশনা জারির আগে বিভিন্ন বিমান সংস্থা ও ট্রাভেল এজেন্সি গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে যেসব টিকিট ব্লক করে রেখেছিল, সেসব টিকিট সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট যাত্রীর নামে বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। সেটি না হলে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার তিন দিনের মধ্যে এসব টিকিট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এ ছাড়া গ্রুপ বুকিংয়ের ক্ষেত্রে টিকিটের প্রকৃত বিক্রয়মূল্য বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। পরে মন্ত্রণালয় এই দাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। শুধু তা-ই নয়, এখন থেকে সব ধরনের বিমান টিকিট অনলাইনে বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সে ক্ষেত্রে অনলাইনে ও টিকিটের গায়ে দাম উল্লেখ করতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, টিকিটের চাহিদা না থাকার পরও চাহিদার অতিরিক্ত টিকিট মজুত করে পরে অন্য এজেন্টের মাধ্যমে বিক্রির কারণে টিকিটের দাম বাড়লে সে ক্ষেত্রে মূল ট্রাভেল এজেন্সির নিবন্ধন সনদ বাতিল বা স্থগিত করা হবে। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াসহ বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীদের টিকিট ভাড়া কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, টিকেট সিন্ডিকেটটি নিজেদের মধ্যে একটি চক্র করে জিম্মি করে যাত্রীদের পকেট কাটছে। তারা অনলাইনে টিকিট শূন্যতা দেখিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। টিকিট সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে রীতিমতো অসহায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিক ও অন্যান্য যাত্রীরা। কারণ নির্ধারিত তারিখের মধ্যে যাওয়া-আসার বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা বেশি দামে টিকিট কিনে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যেও যারা যাতায়াত করছেন তাদেরও একইভাবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশে নয় ইউরোপ আমেরিকার রুটেও সিন্ডিকেট করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চক্রগুলো এমনটি করলেও কোনোভাবে সেটি বন্ধ করা যাচ্ছিল না।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার পতন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর বিদেশযাত্রা কিছুটা কমলেও এখন পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। অতিরিক্ত ভাড়া হলেও বাধ্য হয়েই বিদেশ যেতে হচ্ছে। বছরব্যাপিই যেন টিকেটের দাম বাড়ে। এমনকি পর্যটন মৌসুমেও বেড়ে যায় টিকিটের চাহিদা। এই সুযোগে গত প্রায় দু’বছর থেকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম। এ ছাড়া ওমরা ও হজকে ঘিরেও চক্রগুলো টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে টিকিটের দাম লাগামহীন হওয়াতে যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি অভিযোগ দিয়ে আসছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে টিকিটের দাম সহনীয় রাখতে মন্ত্রণালয় থেকে ভাড়া সহনীয় রাখতে এয়ারলাইনসগুলোকে নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বেবিচককে চিঠি দেয়া হয়। পরে ভাড়া সহনীয় রাখতে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এর আগে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সংগঠন এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশও (আটাব) উড়োজাহাজ ভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। আটাব জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেশি বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাড়া বেড়েছে জেদ্দা, মদিনা, রিয়াদ ও দাম্মাম রুটে। এসব গন্তব্যে ভাড়া বাড়লে সংশ্লিষ্ট অন্য গন্তব্যগুলোতেও এয়ারলাইন্সগুলো ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। সামগ্রিকভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এবং কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি বেড়েছে। কিছুদিন আগেও যে টিকিটের দাম ৪০ হাজার ছিল এখন সেটি ৮০ হাজারের বেশি। ট্রাভেল এজেন্টরা বলছেন, ৫ থেকে ৭ শতাংশ দাম বাড়লে সেটি স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। কিন্তু ৪০-৫০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বাড়লে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। বেশি দাম দিয়েও অনেকে টিকিট পাচ্ছে না। তাই সমাধানের জন্য যারা টিকিট নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ফ্লাইট ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। ক্যাপাসিটি বাড়লে টিকিটও সহজলভ্য হবে, দামও কমবে।
বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি রেগুলেশনস ও ইন্সপেকশন অথরাইজেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আহসান হাবীব বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা বিদেশি ২৪টি এয়ারলাইন্সকেও ভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। অবশেষে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় তিন দিনের বেশি বিমান টিকেট বুকিং বন্ধ করে দেয়া হয়।