Image description

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সরকারের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। কোনোভাবেই লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি এবং খুনের মতো ভয়ংকর ঘটনার। গা শিউরে ওঠা এসব ঘটনা রীতিমতো দুর্বৃত্তদের প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়াবহ আতঙ্ক চেপে বসেছে সারা দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আগাম গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতার দায় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে বাধ্য। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গতরাত থেকেই কম্বাইন্ড অপারেশন শুরু করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা নেওয়া। স্থানীয় ভিত্তিতে বাড়ানো উচিত ছাত্র-জনতার সম্পৃক্ততা। প্রয়োজনে তাদের নিয়েই টহল-প্যাট্রোলে যাওয়া উচিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। স্বচ্ছতার জন্য অপারেশনগুলো ক্যামেরাবন্দি করে রাখা যেতে পারে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও জটিলের দিকে টার্ন নিতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করীম মল্লিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের প্রতিটি সদস্য তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে যাচ্ছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার লোকজন পরিকল্পনা করে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। তবে তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দীন এলান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতেও খুব একটা ভালো ছিল তা বলা যাবে না। গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মনোবল ভেঙে পড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চাঙা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উচিত ছাত্র-জনতার সহায়তা নেওয়া। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ সময় এগিয়ে এসে ক্রেডিট নেওয়া উচিত। তাদের নেতা-কর্মীদের উচিত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের টহল এবং অপারেশনে সহায়তা করা।

রবিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে মোহাম্মদপুরে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায়, একটি রিকশা থামিয়ে দুই তরুণ ছিনতাই করছে। রিকশায় এক নারীকে বসে থাকতে দেখা যায় এবং তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক নারী। এ সময় দাঁড়িয়ে থাকা নারীর দিকে এক ছিনতাইকারীকে চাপাতি হাতে তেড়ে যেতে দেখা যায়। সেখানে আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায়, ছিনতাইকারীদের সরিয়ে দিতে। তবে তিনি ওই দুই নারীর সঙ্গে ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় আনোয়ার হোসেন (৪৩) নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও টাকা লুটের ঘটনাও ঘটেছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রী ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখা যায়, তিনটি মোটরসাইকেলে প্রায় সাতজন তার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিতেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এরপর সঙ্গে থাকা স্বর্ণ ও টাকা নিয়ে যায়। বিশেষ করে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশে বিমানবাহিনীর নির্মাণাধীন ঘাঁটিতে হামলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় দেশব্যাপী আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শিহাব কবির নাহিদ (৩০) নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। দিনব্যাপী ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনায় দায়িত্বপালন করে যাওয়া সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বিএনপির সাবেক একজন এমপি লুৎফুর রহমান কাজলের সহায়তা নেয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কক্সবাজারের ঘটনার মাত্র দেড় ঘণ্টা পর বেলা ১টার দিকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালি পর্যটন কেন্দ্রে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অন্তত ৭০টি রিসোর্ট পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, অবকাশ রিসোর্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনে অবকাশ রিসোর্ট, ইকো ভ্যালি রিসোর্ট, মেঘছুট রিসোর্ট, মনটানা রেস্টুরেন্ট ও মারুয়াতি রেস্টুরেন্ট পুড়ে ভস্মীভূত হয়। ফায়ার সার্ভিস না থাকায় স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সাজেকে ফায়ার সার্ভিস না থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরীন আক্তারের।

যদিও আগের রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দোসররা নানা ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) আশরাফুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণ অভ্যুত্থানের পর এমন ঘটনা ঘটবে তা খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। পরাজিত শক্তির অনুচররা সক্রিয় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের ইন্টিলিজেন্স ফেইলর ছিল। বিরোধীদের ষড়যন্ত্র এবং তাদের অপকর্ম থেকে দেশকে বাঁচাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর টহল জোরদার করতে হবে। থানাকে আরও সক্রিয় করতে হবে। তালিকা করে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিউনিটি এবং সচেতন মানুষের সহায়তা নিতে হবে। বর্তমান সময়ে তাদের সহায়তা নেওয়া খুব দরকার। কারণ একটি থানায় যে পরিমাণ ফোর্স থাকে তা কখনো পর্যাপ্ত নয়।

যা ছিল গোয়েন্দা প্রতিবেদনে : গত দুই মাস আগে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর অপতৎপরতার বিষয়টি। বলা হয়েছিল, তারা নানা কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে নিশানা করবে। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অগ্নিসংযোগ (কেপিআইসহ) করবে। ধর্মীয় স্থানে অতর্কিত হামলা এবং সুউচ্চ ভবনে অগ্নিসংযোগ করবে। সরকারি স্থাপনায় হামলাসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের কনসাইনমেন্টে হামলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রাইস স্যাবোটাজ করার লক্ষ্যে সাপ্লাইচেইনে আঘাত করবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশন/দূতাবাসে বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করবে (মিশন/দূতাবাস কর্তৃক অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিপরীতে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ)। যে কোনো উপায়ে সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর ভিতর উত্তেজনা সৃষ্টি, বাহিনীর সদস্যদের মাঝে গণ হিস্টেরিয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নেতিবাচক প্রচার, একই সময়ে বিভিন্ন এলাকা/গ্রাম/উপজেলা/জেলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেসব এলাকা দখলে নেওয়ার চেষ্টা, সাইবার আক্রমণ করে ওয়েব নির্ভর বিভিন্ন সেবা ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা, অর্থনৈতিক ট্রানজাকশন অচল করে পুরো অর্থনীতি স্যাবোটাজ করা, অর্থনৈতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটতরাজ, ভাড়াটে ব্যক্তিদের সহায়তায় কৃত্রিম মবভায়োলেন্স সৃষ্টি করা হবে।

যা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অপারেশন আরও জোরদার করা হচ্ছে। গতকাল বিকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এদিন (গতকাল) সন্ধ্যার পর থেকেই তা দেখতে পাবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে অপারেশন আরও জোরদার করা হবে। অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে আরও টহল বাড়ানো হবে, চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হবে।

প্রেস সচিব : একই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে কম্বাইন্ড প্যাট্রোলিং চলবে। ঢাকাসহ যেসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, সেসব জায়গায় আমরা প্যাট্রোলিং বাড়াব। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই পুরো ঢাকা শহরে এটি শুরু হচ্ছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, নেভি- সবাই একসঙ্গে কম্বাইন্ড প্যাট্রোলিং করবে। অনেক জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হবে। বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হবে। শফিকুল আলম বলেন, ঢাকা খুবই যানজটপূর্ণ শহর। কোথাও কিছু ঘটলে সেখানে যেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেরি হয়। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে প্রচুর মোটরসাইকেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব দ্রুত মোটরসাইকেল কেনা হবে যেন দুজন করে দ্রুত মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে যেতে পারেন। আপাতত পুলিশের জন্য ১০০ মোটরসাইকেল নেওয়া হচ্ছে। পরে আরও ১০০ নেওয়া হবে। অন্যান্য বাহিনীর যারা আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত, তাদের জন্যও কিছু নেওয়া হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, শুধু রাজধানীতে গেল ছয় মাসে খুনের ঘটনা প্রায় ২৫০। আর চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতি ৭৭২টি। এসব ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাতের আঁধারে রাজধানীতে অপরাধ সবচেয়ে বেশি। বেকারত্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা না থাকাকে অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।