
ঢাকার লক্কড়ঝক্কড় পুরাতন বাসগুলোর রং বদলানো হয়েছে। করা হয়েছে গোলাপি রং। সেই বাসগুলোই গোলাপি বাস নামে চালানো হচ্ছে ঢাকার সড়কে। ব্যবস্থা করা হয়েছে আগের ‘অকার্যকর’ ই-টিকেটিং ও কাউন্টার পদ্ধতি। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর দাবি করে গোলাপি বাস নামানোর ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। আদতে শুধু রং বদলানো হলেও চরিত্র পাল্টায়নি। চলছে আগের মতো বিশৃঙ্খলভাবেই। এদিকে, মঙ্গলবার থেকে নগর পরিবহন ৩৫টি এসি বাস চালু করছে ‘ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)’। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একক কোম্পানির আওতায় ছাড়া এভাবে শুধু রং করে ঢাকায় বাস নামিয়ে দিলেই শৃঙ্খলা ফিরবে না। তা ছাড়া বর্তমান মালিকদের অধীনে একক কোম্পানির আওতায় বাস চালালেও শৃঙ্খলা ফেরার সম্ভাবনা নেই। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সরকারি মালিকানায় একক কোম্পানির আওতায় বাস চালাতে হবে।
সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা যায়, অন্যান্য বাসের মতোই গোলাপি বাসেও চলছে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা। কাউন্টারে টিকিট কাটার ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। বাসের যাত্রীরা যার যেখানে খুশি হাত উঠালেই উঠতে পারছেন। দাঁড়িয়েও নেয়া হচ্ছে যাত্রী। গোলাপি বাসে চড়া রোমান আহমেদ নামে একযাত্রী কাওরান বাজার স্টপেজের আগেই নেমে যান। তিনি বলেন, এর আগেও অনেক নিয়ম করা হয়েছে। সেগুলো বেশিদিন টিকেনি। ই-টিকেটিং বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আবার এই বাসে চালু হয়েছে। কিন্তু তাও কেউ মানছে না। তুমুল নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পুরনো বাসগুলোই রং করা হয়েছে। নতুন কোনো বাস নামেনি। আগের মতোই বাসে যাত্রীদের ভিড় লেগে থাকে। দাঁড়িয়েও যাত্রী তোলা হয়। যাত্রীদের না উঠেও উপায় নেই। অফিস সময়ে পর্যাপ্ত বাসও থাকে না। হেলাল নামে এক যাত্রী বলেন, নির্দিষ্ট স্টপেজ আর টিকিটে ভাড়া কেটে যাত্রী ওঠার সিস্টেম আসলেই সুন্দর উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আমরা যারা বাসে নিয়মিত যাতায়াত করি তাদের জন্য অনেক উপকারী। কিন্তু সেটা কখনোই হয় না। গোলাপি বাসও যেখান সেখান থেকে যাত্রী তোলে।
লক্কড়-ঝক্কর বাসগুলোকে শুধুমাত্র রং করে সড়কে ছাড়লে তাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না উল্লেখ করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমাদের গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার মূল কারণ বাসগুলোর মালিকদের একক কোম্পানির আওতায় আনা যায়নি। এখন রং করে ২১টা কোম্পানির বাস চলছে। একটি একক কোম্পানি তৈরি করা হয়নি।
ঢাকায় ২১টি কোম্পানির অধীনে ২ হাজার ৬১০টি গোলাপি বাস নামানোর ঘোষণা দেয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। গত ৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে গোলাপি বাস যাত্রা শুরু করে। আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে বাসগুলো চালানো হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে পুরাতন বাসগুলো গোলাপি রং করে সড়কে নামানো হচ্ছে। তবে এখনো পর্যাপ্ত গোলাপি বাস চোখে পড়ছে না। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে এক-দুইটা গোলাপি বাস দেখা যায়। বিহঙ্গ পরিবহনের চালকের সহকারী শামীম আহমেদ বলেন, আমরা তো মালিকদের নির্দেশনা মেনেই বাস চালাই। মালিক যা করতে বলবেন সেভাবে চালাতে হবে আমাদের। অফিস টাইমে যাত্রীদের চাপ থাকে অনেক। তাদের না বললেও বাসে উঠে পড়ে। এয়ারপোর্ট পরিবহনের হেলপার আকিজ বলেন, আমাদের অনেকগুলো বাস রং করানোর জন্য দেয়া হয়েছে। সব বাস একসঙ্গে দিলে যাত্রীরা কীভাবে যাতায়াত করবেন। এমনিতেই বাস এখন কম চলছে রোডে। মো. মিলন হোসেন নামে ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের স্টাফ ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমাদের কাওরান বাজার রুটে আগে ৩০টি বাস চলতো। আমাদের অনেকগুলো বাস গোলাপি রং করানোর জন্য পাঠানো হয়েছে। অল্প কিছু আমরা রাস্তায় চালাচ্ছি। যেগুলো রং করানোর জন্য পাঠানো হয়েছে সেগুলো আসলে আমাদের বাকিগুলো পাঠানো হবে।
ডিটিসিএ’র এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঢাকায় মোট পাঁচ হাজার বাস চলে। এর মধ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের একক কোম্পানির অধীনে তিন হাজার বাস আসতে চেয়েছিল। তবে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির গোলাপি বাস নামানোর কারণে তারা সেখানে চলে যাচ্ছে। এতে বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে। ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার মানবজমিনকে বলেন, একক কোম্পানির আওতায় বাস আনার জন্য আমরা কাজ করছি। তবে এটার মডেল আমরা স্থাপন করতে পারি নাই। এই মডেল স্থাপন করতে হবে। এজন্য আমরা কাজ করছি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্দেশ্য ছিল- বাসগুলোর রেষারেষি কমানো; যাতে যানজট কমে যায়। দুর্ঘটনা কম হয়। এই উদ্দেশ্য সফল হওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না, মালিক সমিতি যেভাবে বাস চালু করেছে। বাসগুলোর অধিকাংশই কাগজপত্র ঠিক নাই, রুট পারমিট নাই, ফিটনেস নাই। ডিটিসিএ যেভাবে চেষ্টা করছিল সেটার সঙ্গে আমিও একমত নই। কারণ বর্তমান রুটগুলোর মালিকদের নিয়েই তারা কোম্পানি তৈরি করবে। সেটা টেকসই হবে না।
সড়কে পরিবহনের বিশৃঙ্খলা ঠিক না হওয়ার সমস্যাটি টেকনিক্যাল নয় বরং রাজনৈতিক উল্লেখ করে এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, ৪২টা রুটে যদি বাসগুলোকে ৯টা ক্লাস্টারে চালাতে হয়, তাহলে অবশ্যই সরকারি মালিকাধীন কোম্পানি তৈরি করতে হবে। ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এর কোনো বিকল্প নেই। যারা এখন ব্যবসা করছে, তাদের এখানে রাখতে হবে। তারা প্রয়োজনে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হবেন। এখানে বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে, লাভের অংশও পাবে। এমন ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করতে পারলে এবং ব্যবসায়ীদের লাভের নিশ্চয়তা দেয়া গেলে সবাই আগ্রহী হতো। আমাদের সমস্যা টেকনিক্যাল সমস্যা না। এটা রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন থাকলে উদ্যোগ সফল হবে।
এদিকে, ডিটিসিএ’র নেয়া উদ্যোগে বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় ঢাকার সড়কে নামানো হচ্ছে গ্রিন ক্লাস্টারের এসি বাস। মঙ্গলবার গাবতলী থেকে চাষাড়া পর্যন্ত বোরাক পরিবহনের ৩৫টি এসি বাস দিয়ে যাত্রা করবে গ্রিন ক্লাস্টার। এ ছাড়া এক মাসের মধ্যে এই রুটে যুক্ত করা হবে আরও ১৫টি বাস। বাসের প্রতি কিলোমিটার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ধরা হয়েছে ২০ টাকা। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সংসদ ভবনের সামনে থেকে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এ ছাড়া সড়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডিটিসিএ, ডিএমপি, বিআরটিএ, বিআরটিসি ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
বাস রুট রেশনালাইজেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা জুড়ে যে ৯টি ভিন্ন রঙের বাস চলার কথা রয়েছে, তার মধ্যে শুরুতে গ্রিন ক্লাস্টার চালু হচ্ছে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) সূত্র জানায়, গ্রিন ক্লাস্টারের সংশ্লিষ্ট রুটের সঙ্গে ৯০ শতাংশ মিলে যাওয়া রেড ক্লাস্টারের ১১ নম্বর রুটটি (আংশিক) এখন থেকে গ্রিন ক্লাস্টারের ২১ নম্বর রুট (সংশোধিত) হিসেবে পরিচিতি পাবে, যার পথ দূরত্ব প্রায় ৩১ কিলোমিটার। সংশ্লিষ্ট রুটে বর্তমানে এসি বাস নেই। অপরিকল্পিতভাবে এই রুটে ৭০টির বেশি বাস চলে। এ প্রেক্ষিতে বর্তমানে বাসের চাহিদা ৫০টি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পরবর্তীতে কম-বেশি করা যাবে। আপাতত ৩৫টি এসি বাস দ্বারা রুটটি উদ্বোধন করা হবে। বাকি ১৫টি বাস এক মাসের মধ্যে সড়কে যুক্ত করার কথা রয়েছে। এই রুটের সম্ভাব্য স্টপেজগুলো হলো- গাবতলী, টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদগেট, ধানমণ্ডি ২৭, কলাবাগান, ধানমণ্ডি ৪, সাইন্স ল্যাব, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, গুলিস্তান, হানিফ ফ্লাইওভার, কাজলা, সাইন বোর্ড, জালকুরি, শিবু মার্কেট ও চাষাড়া। এসব স্টপেজ থেকে ই-টিকেটিংয়ের মাধ্যমে টিকিট কেটে যাত্রীরা বাসে উঠতে পারবেন। নির্দিষ্ট স্টপেজ ব্যতীত কোথাও বাসগুলো দাঁড়াবে না এবং যাত্রী উঠা-নামা করবে না। নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট বাসের অভ্যন্তরে প্রদর্শনের জন্য টাঙানো থাকবে। বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রকল্প পরিচালক ধ্রুব আলম মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় মঙ্গলবার থেকে নতুনরূপে গ্রিন ক্লাস্টারের ৩৫টি এসি বাস চালু করা হবে। সড়ক উপদেষ্টা এর উদ্বোধন করবেন। ঈদের পর আরও দুইটি রুট চালুর পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।