Image description

রাজধানী ঢাকায় হরহামেশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এমন অন্তত ২৫টি স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা সূত্র, বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ছিনতাইয়ের মামলা এবং জিডিকে পর্যালোচনা করে এসব স্পট নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ছিনতাইয়ের স্পটগুলো নির্ধারণের পরও কেন ওইসব স্থান ঘিরে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, এ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কেন ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না এবং অপরাধ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছেন না, তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন রাজধানীবাসী।

 

ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, দিন-রাত কোনো সময়েই এই শহরে আমাদের নিরাপত্তা নেই। রাজধানী ঢাকা এখন অপরাধীদের জন্য স্বর্গরাজ্য। ছিনতাইকারীরা রাতে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই অপারেশন চালাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম দেখলে যে কারোরই মনে হবে, এই শহরে তাদের থামাবে এমন কোনো শক্তি নেই। প্রশাসন শক্ত অবস্থানে থাকার জানান দিলেও কার্যত মাঠ পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই।

রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় ঘটে গেছে দুর্ধর্ষ এক ছিনতাইয়ের ঘটনা। বনশ্রী ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে তিনটি মোটরসাইকেলে করে মোট সাতজন ছিনতাইকারী আনোয়ার হোসেন (৪৩) নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। লোমহর্ষক এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নগরবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। একাধিক পেজ ও আইডিতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির কমেন্টে ঢাকা শহরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

 
 

ঘটনার ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ব্যবসায়ীকে যখন প্রকাশ্যে গুলি করা হচ্ছিলো তখন তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য ‘মাগো মাগো করে চিৎকার করছিলেন’। কিন্তু তখন তাকে বাঁচাতে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে যেসব বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন তাদের কাউকেই আসতে দেখা যায়নি।

dhakapost

যদিও প্রতিনিয়ত এসব বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাতের ঢাকার নিরাপত্তায় টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা ঘটার সময় কোনো টহল পার্টিকে কেন পাওয়া যায় না প্রশ্ন নগরবাসীর। রোববার রাতে বনশ্রীর ওই ভয়াবহ ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করছেন, গত ২০ বছরেও তাদের এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি। তারা বলছেন, ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ঘটনাস্থলে এসেছে শুধু ক্যামেরার সামনে নিজেদের ছবি তুলতে। তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে ছবি তোলা, নিরাপত্তা দেওয়া নয়। 

ইসরাত জাহান পপি নামে বনশ্রী এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমি বনশ্রী এলাকায় আছি ২০০৫ সাল থেকে। এ পর্যন্ত ডাকাতি তো দূরের কথা, আমার এলাকায় কখনো ছিঁচকে চুরিও হয়নি। তবে, রোববার রাতের মতো এত আতঙ্ক আর কখনো লাগেনি। দরকার হয় সবাই মিলে ব্লক-ভিত্তিক পাহারার ব্যবস্থা করা হোক। প্রয়োজনে আমি নিজেও নামবো।’

বাড্ডার বাসিন্দা মো. সাইদুর রহমান বলেন, রাত কিংবা দিন এখন কোনো সময়ই এই শহরকে আর নিরাপদ মনে হয় না। মনে হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চোর-ছিনতাইকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আর তো কোনো বাহিনী নেই যে সরকার মাঠে নামাবে, সব বাহিনীই তো আছে মাঠে। তাহলে এই অবস্থা কেন?

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২৯৪ জন। এ সময়ে ১৭১টি চুরি, ৭১টি ডাকাতি, ১০৫টি অপহরণ এবং নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৪৪০টি। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় এবার চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে।

তবে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, জুলাই আন্দোলনের সময় লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। আর এই অস্ত্র দিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে সব মিলিয়ে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়। তার মধ্যে এখনও বেহাত ১ হাজার ৩৮৪টি।

ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশ বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সময়ে আমরা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আমরা ছিনতাইকারীসহ বিভিন্ন অপরাধীদের আইনের আওতায় আনছি। প্রতিদিনই অনেক অপরাধী গ্রেপ্তার হচ্ছে। পুলিশ ঢাকা শহরসহ সারাদেশে রাত্রিকালীন টহল বাড়িয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। অন্যদিকে সারাদেশে বিভিন্ন এলাকায় অপরাধপ্রবণ হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

dhakapost

ঢাকায় ছিনতাইপ্রবণ এলাকা

সম্প্রতি ছিনতাইকারী ও ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি স্পটকে ছিনতাইকারীদের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে চিটাগাং রোড থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত; রায়েরবাগ, শনির আখড়া থেকে কুতুবখালী, বনানী ব্রিজ, বাবুবাজার, কদমতলী, বাদামতলী, মতিঝিল শাপলা চত্বর, ধানমন্ডি ৩২ থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ যাওয়ার রাস্তা রয়েছে।

তবে ঢাকা শহরের মধ্যে ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য বলা চলে মোহাম্মদপুরকে। মোহাম্মদপুর ও বছিলা এলাকায় ছিনতাইকারীদের দমন করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, বছিলা ৩ রাস্তার মোড়, বছিলা ব্রিজ, নবোদয় হাউজিং, রায়ের বাজার, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, বুদ্ধিজীবী কবর স্থানের বিপরীত পাশের রাস্তা ও বছিলা গার্ডেন সিটি এলাকায় ছিনতাইকারীর উৎপাত বেশি লক্ষ্য করা যায়।

অন্যদিকে শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী পকেটগেট, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান, আসাদগেট, মিরপুর ১১, বিহারি ক্যাম্প, কালশী, পশ্চিম শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০ গোল চত্বর, মতিঝিল, পল্টন, এয়ারপোর্ট, কুড়িল বিশ্বরোড, বাঁশতলা, রামপুরা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে তথ্যে উঠে এসেছে।

অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে : ডিএমপি

তবে হটস্পটে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ দমনে ডিএমপি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। রাজধানীর অপরাধের হটস্পটগুলোতে ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে।

dhakapost

এদিকে ছিনতাইকারীদের বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান রেজাউল করিম মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকায় ছিনতাইকারীদের দমনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ছিনতাই রোধে এবং ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা ডিবির স্পেশাল টিম করেছি। আমাদের টিম প্রতিনিয়ত মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের নিরাপদে রাখতে যা যা করার প্রয়োজন তা করছে ডিবি।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সক্রিয় নয়। আর সেজন্যই রাজধানীতে হরহামেশাই চুরি-ছিনতাই-খুনের ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সময়ে ঢাকাসহ দেশের সব বড় বড় শহরে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যখন ঢিলামিভাব চলে আসে তখন এ ধরনের অপরাধ অনেক বেড়ে যায়। আর এখন ঠিক তাই হচ্ছে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে যারা মাদকাসক্ত ও অভাবগ্রস্ত ছিলো তারা মাঝে মধ্যে চুরি-ছিনতাই করতো। কিন্তু এখন দেশে একটি অপরাধ শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। তারা এখন চুরি-ছিনতাইকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রের মাধ্যমে এসব অপরাধ করছে। তাদের পেছনে অনেক পৃষ্ঠপোষকও আছে, যারা টাকার ভাগ পায়।

তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যতদিন পর্যন্ত জোরালো ভূমিকা না রাখবে ততদিন পর্যন্ত এ অপরাধ বাড়তেই থাকবে।