Image description

দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মাঝে বিরাজ করছে অস্থিরতা। অর্থায়ন সংকট, ঋণ সহায়তা হ্রাস, ভ্যাট বাড়ানো, গ্যাসের দাম ও সুদহার বৃদ্ধির কারণে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বেড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। বেসরকারি খাতের সমপ্রসারণও কম হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে ক্রয়ক্ষমতা কমছে সাধারণ মানুষের। 

দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, গত ৫ই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের অর্থনীতিতে ভালো বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়নি। নতুন বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকছেন অনেকেই। বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এসব চিত্র বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। 

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-শিল্পকারখানা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানিয়েছে বাণিজ্য সংগঠনগুলো। কোনো কোনো সংগঠন দ্রুত নির্বাচনও চাচ্ছেন। তাদের মতে, সরকার বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। এ কারণে এখন নতুন বিনিয়োগের চিন্তা কেউ করছে না। যেসব উদ্যোক্তা ব্যবসা সমপ্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, তারা এখন পর্যবেক্ষণ করছেন। ফলে উৎপাদন ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। 
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরু থেকে ক্রমাগতভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। এরই মধ্যে নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতিতেও সুদহার একই রেখেছে। ফলে কিছুটা স্বস্তির কথা বলেছে ব্যবসায়ীরা। 

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মন্দা: কয়েক বছর ধরেই দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশ মন্থর। গত ছয় মাসে তা আরও মন্থর হয়ে এসেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে মাত্র ১.৪১ শতাংশ। যেখানে এর আগে গত অর্থবছরের একই সময়ে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৪৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। নভেম্বর শেষে ঋণের এ স্থিতি বেড়ে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সে হিসাবে পাঁচ মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি বেড়েছে মাত্র ২৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। আর ঋণ প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১.৪১ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ এর আগে এতটা মন্থর হয়ে আসতে দেখা যায়নি। এখন ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে এরও বড় অংশ এসেছে অনাদায়ী সুদ ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে।
বিদেশি বিনিয়োগে খরা: দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) খরা কাটছে না, উল্টো পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৭১ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক প্রান্তিকে এত কম এফডিআই গত ১১ বছরে কখনো আসেনি। 
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে: বিনিয়োগ কমার চিত্র উঠে এসেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকের সুদের হার বেশি, নানা রকমের সমস্যা, ব্যাংকগুলোর চরম অসহযোগিতাসহ নানা কারণে একেবারেই বিনিয়োগ নেই।
উদ্যেক্তারা বলেন, বর্তমানে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি অনিশ্চিত। অর্থনীতিতে নতুন বিনিয়োগের চিন্তা এখন কেউ করছে না। অনেকে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে থমকে আছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক রয়েছেন। তারা যখন দায়িত্ব নিয়েছেন তখন দেশের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক অবস্থায় পেয়েছেন। এ পরিস্থিতিকে গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি রপ্তানি বাজার নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। 
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিয়ে বলেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যয় নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছে। তাদের লোনের টাকা শোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয় প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। তবে বিনিয়োগে একটা ভাটা তৈরি হয়েছে। 
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়াম্যান ও এফবিসিসিআইএর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেটা এখনো হয়নি। 
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে অর্থনীতিতে সফলতা নেই বললেই চলে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়ে গেছে। অন্যান্য যেসব সমস্যা আছে সেখানেও খুব একটা সফলতা নেই। ফলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। 
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঘুষ দুর্নীতি এগুলো কিন্তু কমে নাই। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপি’র ২৩.৫ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ সেটা জিডিপি’র এক শতাংশের নিচে ছিল। সেটা কমে কমে ০.৩ এর কাছাকাছি রয়েছে। একটা বড় সময় ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা কোনো সময়ই সারা পৃথিবীতেই কোনো জায়গায় বিনিয়োগ করতে চাইবে না যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকে। এবং অনেকেরই আমাদের সঙ্গে তো কথাবার্তা হয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। তারা বলেছে যে ইলেকশনের আগে তারা নতুন বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে না। এটা দুশ্চিন্তার কারণ। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সিপিডির জরিপে ১৭টি সমস্যা সামনে এসেছে, এর মধ্যে দুর্নীতি এক নম্বর।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতে নানা সংস্কার শুরু করেছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যেও পদক্ষেপ নিচ্ছে। আগামীতে ব্যবসা সংকট উত্তরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন সেটি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।

অর্থনীতিসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ৩১ সুপারিশ: অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অর্থনীতি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স ৩১টি সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। সুপারিশগুলোতে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যেমন-১০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানির সক্ষমতা রয়েছে এমন ১ হাজার ৫০০ কোম্পানিকে বিশেষ নীতির আওতায় আনা, এসএমই খাতকে সমর্থন করতে ‘ঢাকা হাট’ প্রকল্প স্থাপন, আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধ করা এবং বিভিন্ন শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ। প্রতিবেদনে দেশের বিনিয়োগযোগ্য খাতগুলোর বিশদ বিবরণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন এবং সরকারি দপ্তরগুলোর প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।