আগামী মার্চ পর্যন্ত সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোর টিকিট নেই ট্রাভেল এজেন্টগুলোর কাছে। তাদের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোতে পর্যাপ্ত ফ্লাইট না থাকার সুযোগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এয়ারলাইনসগুলো নিজেদের মতো করে টিকিট ব্লকের জমাজমাট বাণিজ্য করছে। টিকিট সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে অসহায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিক ও যাত্রীরা। একের পর এক পদক্ষেপেও আকাশপথের ভাড়া নৈরাজ্য থামছে না।
এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) জানিয়েছে, এয়ার টিকিটের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ নামবিহীন গ্রুপ টিকিট বুকিং। মধ্যপ্রাচ্যগামী কিছু এয়ারলাইনস তাদের পছন্দের কিছুসংখ্যক এজেন্সির নামে কোনো ধরনের পাসপোর্ট, ভিসা, ভ্রমণ নথিপত্র এবং প্রবাসগামী শ্রমিকদের কোনো বৈদেশিক ওয়ার্ক পারমিট, এমনকি যাত্রী তালিকা ছাড়াই শুধু ই-মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন রুটের গ্রুপ সিট দুই থেকে তিন মাস অগ্রিম তারিখের প্যাসেঞ্জার নেম রেকর্ড (পিএনআর) তৈরি করে সিট ব্লক করে রাখে। এভাবে টিকিট মজুদদারি করার ফলে সিন্ডিকেট তৈরি হয়, আসনসংকট দেখা দেয়, টিকিটমূল্য ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। আবার কখনো দ্বিগুণ-তিন গুণ পর্যন্ত বাড়ে এবং বিদেশগামী শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও প্রবাসীরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
এমন পরিস্থিতিতে এবার সিন্ডিকেট ভাঙতে তৎপর হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এয়ারলাইনস-ট্রাভেল এজেন্সির অনৈতিক মুনাফায় লাগাম টানতে এবার নেমেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সিএ-২ অধিশাখা থেকে জারি করা পরিপত্রে বলা হয়েছে, ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে বিদেশগামী শ্রমিক ও কর্মীদের জন্য উড়োজাহাজে বিশেষ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
পরিপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইনস এবং ট্রাভেল এজেন্সি ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে বিদেশগামী শ্রমিক ও কর্মীদের জন্য বিশেষ বিমান ভাড়ার ব্যবস্থা করবে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত এয়ারলাইনস/ট্রাভেল এজেন্সি কর্তৃক গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে এরই মধ্যে ব্লককৃত টিকিট আগামী সাত দিনের মধ্যে ভ্রমণেচ্ছু যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের কপিসহ বিক্রয় নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস এমন টিকিট স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বাতিল করবে।
গ্রুপ বুকিংয়ের ক্ষেত্রে টিকিটের প্রকৃত বিক্রয়মূল্য বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে এবং মন্ত্রণালয় তা জনগণকে জানাতে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। এভিয়েশন খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা তদারকি করতে না পারলে সুফল মিলবে না।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বড় এয়ারলাইনসগুলো গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে সাধারণত কারসাজি করে না। এগুলো করে মূলত বাজেট এয়ারলাইনসগুলো। তারা অনেক আগে থেকে গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে থোক বিক্রি করে দেয় চড়া দামে। তাদের অনৈতিক কাজের সুবিধা কিছু অসৎ ট্রাভেল এজেন্সি নিয়ে থাকে। বাজারের উচ্চ চাহিদার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা কয়েক গুণ বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরিপত্র জারি হলো, কিন্তু আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা দেখবে কে? তিন দিনের মধ্যে গ্রুপ বুকিং সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে। কিন্তু যারা এসব সিন্ডিকেশন করবে তারা কি জানাবে?’
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত দামের বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না—পরিপত্রের এই নির্দেশনা প্রসঙ্গে কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে এয়ারলাইনসগুলোকে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়ার অনুমোদন নিতে হতো। কিন্তু এখন তো তারা কোনো ভাড়ার অনুমোদন করে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আবার টিকিটের ভাড়া জানতে চাইলে তারা এমন ভাড়া দেবে, তাতে এয়ারলাইনসকে ধরাই কঠিন হবে। বাজেট এয়ারলাইনসগুলোর অনিয়ম যদি শক্তভাবে ধরা যায়, তাহলে কিছু সুফল হয়তো পাওয়া যাবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশের মানুষের ওপর যে জুলুম শুরু করেছিল, তারা যেভাবে ইচ্ছা দাম বাড়াবে, টিকিট ব্লক করে রাখবে, তাদের কয়েকজন সিন্ডিকেটের সদস্যকে দিয়ে টিকিট বিক্রি করবে—এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর নজরদারির অভাবে তারা টিকিট সমস্যা এত দূর নিয়ে আসার সাহস পেয়েছে। আমাদের আইন আরো শক্তিশালী করতে হবে, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে কে কোন দায়িত্ব পালন করবে তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। আমরা আশা করি তারা কঠোরভাবে বিষয়গুলো নজরদারি করে কোনো অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেবে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোতে কেউ যাতে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ না পায় সে জন্য দেশি এয়ারলাইনসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিমানের বিদ্যমান বুকিং এবং টিকিটিং পলিসি অনুযায়ী টিকিট বুকিং বা রিজার্ভেশন সিস্টেমে মধ্যপ্রাচ্যগামী বা শ্রমিক ভিসায় প্রবাসগামী রেমিট্যান্স যোদ্ধা বা অন্য যাত্রীদের ক্ষেত্রে কোনো সেক্টরে নাম কিংবা নামবিহীন গ্রুপ বুকিং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস অনুমোদন করে না। বিমানের বিদ্যমান টিকিট বুকিং বা রিজার্ভেশন সিস্টেমে যাত্রীদের নাম এবং পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্যাদি, যোগাযোগের তথ্যাদি ছাড়া টিকিট বুকিং বা টিকিট বিক্রয়ের কোনো সুযোগ বা অবকাশ নেই। বিমানের টিকিটের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সব নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করেই টিকিটের দাম নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তার অনেক কিছু বিমান আগে থেকেই কমপ্লাই করে আসছে।’
আটাবের সাবেক সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখনো নামবিহীন পিএনআর নেওয়া চলছে। সরকারের পরিপত্র জারির পর এখনো কোনো টিকিটে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যেসব ট্রাভেল এজেন্ট টিকিট সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তাদের ধরা হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরো কঠোর নজরদারি না করলে পরিপত্রের কোনো সুফল আসবে না।’
এদিকে উড়োজাহাজের টিকিট সিন্ডিকেট চিহ্নিতকরণে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে সভাপতি করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে গত ছয় মাসে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিতকরণে যাবতীয় বিষয় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, তদন্ত প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিকে শাস্তির জন্য সুপারিশ করবে এবং টিকিটের উচ্চমূল্যের বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ১৩ সদস্যের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
এর আগে বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি রেগুলেশনস ও ইন্সপেকশন অথরাইজেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আহসান হাবীব বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা বিদেশি ২৪টি এয়ারলাইনসকে ভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।