রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) প্রতিটি নির্দেশ যেন মালিক-চালকদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বিপরীত অবস্থানে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিদের্শ অমান্য করে এখন সাংঘর্ষিক অবস্থায় চালক-মালিকরা।
সম্প্রতি গ্যাস বা পেট্রোলচালিত অটোরিকশার চালক মিটারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) এক চিঠিতে অনুরোধ করেছে বিআরটিএ।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী কোনো কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মালিক বা চালক রুট পারমিট এলাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন এবং মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করতে পারবেন না। এমন অপরাধে আইনের ধারা ৮১ অনুযায়ী অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় নিবন্ধিত অটোরিকশা ২০ হাজার ৮৯৪টি। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অটোরিকশা নিবন্ধন পেয়েছে ২০১৯ সালে। সেই বছর নিবন্ধন দেওয়া হয় ৬ হাজার ৮৩৯টি। তার আগের বছর ২০১৮ সালে নিবন্ধন পেয়েছে ৫ হাজার ৬৩৭টি
এই নির্দেশনা জানার পর ক্ষুব্ধ হয়েছেন সিএনজি অটোরিকশার চালকরা। তারা বলছেন, সব জুলুম শুধু আমাদের ওপর করা হয়। একদিকে মালিকরা অতিরিক্ত জমার টাকা আদায় করে। অন্যদিকে বিআরটিএ পুলিশ দিয়ে মামলা দেয়। এমন চলতে থাকলে মিটার বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
এমন পরিস্থিতিতে বিআরটিএ’কে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করে একাধিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞান বলে সিস্টেম অবশ্যই ম্যানেজেবল হতে হয়। সিএনজি অটোরিকশা একটি যাত্রী সেবা দেওয়ার বাহন। সিএনজি সিস্টেমকে ম্যানেজেবল করতে হবে। শুরুতে যখন সিএনজি অটোরিকশার কথা এলো, তখন যদি বিআরটিএ বিজ্ঞানটা বুঝতো তাহলে এখন আর এই ঝামেলা হতো না। কারণ, বিআরটিএ সিএনজি অটোরিকশাকে রুট পারমিট দেবে এবং সেই সঙ্গে কিছু শর্ত দেবে। এসব শর্ত কেউ না মানলে তাদেরকে শাসন করতে হবে। শাসন কখনো রিটেইলে (খুচরা) হয় না। একাধিক কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে শাসন করতে হয় ।
বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় নিবন্ধিত অটোরিকশা রয়েছে ২০ হাজার ৮৯৪টি। আর ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের (১০ বছর) মধ্যে সবচেয়ে বেশি অটোরিকশা নিবন্ধন পেয়েছে ২০১৯ সালে। সে বছর নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৮৩৯টি অটোরিকশা। তার আগের বছর ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৩৭টি অটোরিকশা নিবন্ধন দেওয়া হয়।
৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার সাধ্য নেই, জেলই খাটতে হবে
নতুন নির্দেশনা নিয়ে সাধারণ সিএনজি চালকরা বলেছেন, ‘আমাদের সিএনজি মিটারে চলছে না, এ কথা সত্য। অনেক যাত্রী এখন মিটারে যেতে চায় না। কারণ, রাস্তায় বেশিরভাগ সময় জ্যাম থাকে। ফলে মিটারে ভাড়া বেশি ওঠে। এজন্য যাত্রীরা কন্ট্রাক্টে যেতে চায়। এককথায় যাত্রীরাও দায়ী, আমরাও দায়ী। কিন্তু যখন সার্জেন্ট মামলা দেয়, তখন যাত্রী এটা মানে না। তা ছাড়া, আমাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার সাধ্য নেই। জেল দিলে জেলই খাটতে হবে। আর আমাদের মতো লোক যদি ৬ মাস জেল খাটে, তবে বউ-বাচ্চা না খেয়ে মারা যাবে।’
তারা আরও বলেন, ‘যেখানে পুরো দিনের সিএনজি জমা ৯০০ টাকা, সেখানে এক বেলার জন্য মালিক নেয় ৯০০ টাকা। একদিনে তিন বেলা ভাড়া দিয়ে মালিকরা অনেক টাকা জমা ওঠায়। মালিকদের আগে ধরেন। শুধু চালকদের কেন, মালিকদেরও জরিমানা করুক। বতর্মান বাজারে অনেক কিছুর দাম বেড়েছে এবং বাড়ছে। কিন্তু মিটারে ভাড়ার হার বাড়েনি। যদি ওই রেটে চালাতে যাই, তাহলে মালিকের জমার টাকা দিয়ে খালি হাতে বাসায় যেতে হবে।’
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গ্যাস বা পেট্রোল চালিত ৪-স্টোক থ্রি-হুইলারের ভাড়ার হার পুনঃনির্ধারণ করেছিল বিআরটিএ। ওই বছরের ১ নভেম্বর থেকে সেই ভাড়া কার্যকর হয়।
ভাড়ার হারে দেখা গেছে, দৈনিক জমার হার ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৯০০ টাকা; প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪০ টাকা; পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ভাড়ার হার ৭.৬৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১২ টাকা; বিরতিকালে প্রতি মিনিটে ভাড়া ১.৪০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২ টাকা এবং যেকোনো দূরত্বে যাত্রী পরিবহনে বাধ্যতামূলক সর্বনিম্ন ভাড়া ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪০ টাকা।
বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মিটার ভাড়া আপডেট করার দাবি
প্রায় সাড়ে ৯ বছর আগে নির্ধারণ করা ভাড়ার হারের সঙ্গে বর্তমান আর্থিক অবস্থার সামঞ্জস্যতা নেই। এ অবস্থায় বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মিটারে ভাড়া আপডেট করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিআরটিএ’র দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী কোনো কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মালিক বা চালক রুট পারমিট এলাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন এবং মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করতে পারবেন না। এমন অপরাধে আইনের ধারা ৮১ অনুযায়ী অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে
ঢাকা মহানগর সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মো. গোলাপ হোসেন সিদ্দিকি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মিটারের হার না বাড়ালে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। মিটারে চলেনি বলে ২০২২-২৩ সালে কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এখন আবার মামলা দিলে ঢাকা শহরে তোলপাড় হবে। এটা মানা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রয়োজনে আমরা জান দিতে রাজি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময় দিতে হবে ও বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মিটার ভাড়া আপডেট করতে হবে।’
হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে অটোরিকশা চালকদের এ নেতা বলেন, ‘সবকিছু আপডেট না করে মিটারের প্রসঙ্গ সামনে আনলে আমরা দাবি করব— গাড়িতে মিটার রাখা যাবে না। মিটার আমাদের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করেছে, সে পরিমাণ টাকা আমরা জীবনে আয় করিনি।’
‘চট্টগ্রাম শহরে মিটার ছিল, আন্দোলন করে সেটি উৎখাত করা হয়েছে। আমরাও আন্দোলন করে মিটার তুলে দেব। নতুন করে মিটার মামলার খবর পেলেই আমরা আন্দোলনে যাব।’
অথর্ব বিআরটিএ, জানে না কীভাবে ম্যানেজেবল সিস্টেম তৈরি করতে হয়
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকারের উচিত এটাকে রিটেইল ম্যানেজমেন্ট না করে কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট করা। দুইটা কোম্পানি থাকবে, প্রয়োজনে ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার করা হবে। ধরেন, দুইটা কোম্পানির অধীনে ২৫০০ করে মোট পাঁচ হাজার সিএনজি অটোরিকশা থাকবে। কোনো কোম্পানির সিএনজি যদি মিটারে না যায়, তাহলে ওই কোম্পানির রুট পারমিট বাতিল করা হবে।’
‘এখন পুলিশ জরিমানা করলে একজনকে করে। ওই সিস্টেম থাকলে জরিমানা করা হতো ২৫০০ সিএনজির বিনিয়োগকারীকে। তখন ওই কোম্পানি সুবিধা বৃদ্ধি করে নিজের ইনকামটা ঠিক করতো। বিআরটিএকে এখন বলতে হতো না— আমার লোক নেই। এতো সিএনজি কীভাবে কন্ট্রোল করবে? এরা কেউ বিজ্ঞানের লোক নয়, এরা হচ্ছে অজ্ঞানের লোক। সিএনজি অজ্ঞানের লোকের হাতে পড়েছে।’
বর্তমান সময়ে সিএনজির মালিকরা ব্যবসা করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মালিকরা ফিক্সড একটা অ্যামাউন্ট নিয়ে চলে যায়, ব্যবসা করে চালকরা। হাজারে-হাজারে ড্রাইভার। কত জনকে শাসন করবে বিআরটিএ? এটা তো ম্যানেজেবল সিস্টেম না। বিআরটিএ অথর্ব। তারা জানে না কীভাবে সিএনজি ম্যানেজেবল সিস্টেম তৈরি করতে হয়। এগুলো ম্যানেজ করতে হবে আমলাদের। কিন্তু তারা জ্ঞানশূন্য। তারা যে নলেজ নিয়ে চলেন, সেটা দিয়ে দেশ চলবে না।’
‘বর্তমান নির্দেশনায় পুলিশ লাভবান হবে। হাজার-হাজার চালক, কতজনকে তারা ধরবে? তারা কয়েকজনকে ধরবে, বলবে তোমার বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের মামলা হবে। তখন সেই চালক বাঁচার জন্য একটা অ্যামাউন্ট দিয়ে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করবেন।’
সিএনজির মালিকদের একতা নেই, দাবি বিআরটিএ’র
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মো. ইয়াসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মালিকদের ৯০০ টাকা জমার বিষয়ে একটি চিঠি আমার ডিএমপিকে দিয়েছিলাম। এটা দেওয়ার পরপরই মালিকরা দৌড়ে আসলো। তারা বললো— শুধু আমরা কেন আইন মানব, ওদেরকেও (চালকদের) আইন মানতে হবে। তখন আমরা মিটারের চিঠিটা ডিএমপিকে দিলাম। পরে এখন মালিক-চালকদের অবস্থান দেখলাম একেবারে বিপরীতমুখী। এ রকম অবস্থা আমি কখনোই কোনো সেক্টরে দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘চালকরা বলে জমা হওয়া উচিত ৫০০ টাকা। মালিকরা বলে জমা তো আরও বেশি হওয়া উচিত। আমি তাদেরকে বলেছি কে কী বলছে, সেটা বড় কথা নয়। যাত্রীরা আছেন, অন্য গণপরিবহন আছে, সবার সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়টি দেখতে হবে। এ ছাড়া ভাড়া নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি কমিটি আছে। সিএনজির ভাড়া নিয়ে তাদেরকে কাজ করতে বলেছি। এটা এখন কত হওয়া উচিত, তাদের সঙ্গে বসে দেখব।’
মালিকরা খণ্ড খণ্ড অবস্থায়, তাদেরকে এক ছাতার নিচে আনা সম্ভব হবে কি না— এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব মালিকরা আসেন, তাদেরকে বলি আপনারা একটা নেতৃত্বের জায়গায় আসেন। কিন্তু তারা সেই জায়গায় আসছে না। বাসসহ অন্যান্য পরিবহনে মালিক সমিতি দেখেছি, শ্রমিক সমিতি দেখেছি। কিন্তু সিএনজিতে আমরা এ রকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তাদের মধ্যে কোনো একতা পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আমরা মালিক-চালকদের বলেছি আপনারা উভয়পক্ষ যদি বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএর উপরে চাপ দিতে থাকেন, তাহলে তো হবে না। আপনারা নিজেরা বসেন। তখন তারা বলেন— আমরা নিজেরা বসলে মারামারি হবে।’
গ্যাস বা পেট্রোল চালিত অটোরিকশার চালক মিটারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)।