অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পার হয়েছে। এ সময়ে সংস্কার কমিশন গঠন, ভঙ্গুর অর্থনীতি চাঙ্গার চেষ্টায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যাসহ দাবির মিছিলে শ্লথ হয়েছে সরকারের অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতি। এছাড়া নানা ধরনের চক্রান্তের মুখোমুখি হয়েছে সরকার। ছয় মাসে বড় একটা সময় প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় পার করতে হয়েছে। এসব কারণে সরকার জনজীবনে সেভাবে স্বস্তি ফেরাতে পারেনি। সরকারের ওপর রাজনৈতিক দল ও জনগণের পুরোপুরি সমর্থন আছে। কিন্তু তাদের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, তার প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়নি। ফলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে পারছে না জনগণ।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সেদিন ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারে হাত দিয়েছে। এরই মধ্যে এ লক্ষ্যে গঠিত কমিশনগুলো রিপোর্ট দেওয়া শুরু করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফলে আগের মতো এখনো সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে অন্যান্য পণ্যের। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির অন্যতম উপকরণ পণ্যমূল্য এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যে কারণে মূল্যস্ফীতিতেও খুব বেশি সুফল মিলছে না। তবে আশার বিষয় গত অক্টোবরের পর থেকে মূল্যস্ফীতির হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে আন্দোলনকালে থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুট অস্ত্রের মধ্যে ১৩৯২টি এবং তিন লাখ ৯১ হাজার ৪৩৮ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। জেল ভেঙে পলাতক ৭০০ অপরাধী এখনো অধরা। যা সংশ্লিষ্টদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।আন্দোলনে আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যরা কাঙ্ক্ষিত সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উন্নত চিকিৎসা, পুনর্বাসন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতির দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এ কারণে রাস্তায় নামতে হয়েছে আহত ও শহিদ পরিবারগুলোকে। যদিও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আহত ও শহিদ পরিবারের দাবি পূরণে কাজ চলছে। গণহত্যার ঘাতকদের বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু গতি খুবই মন্থর।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, গণহত্যার বিচার, ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারে জড়িতদের বিচার ও টাকা ফেরত আনা এবং দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন। সরকারও প্রথম থেকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে এসব কাজই শুরু করেছিল। কিন্তু সব ইস্যুতে সমানতালে সামনে এগুতে পারেনি। এ কারণে ছয় মাসের মাথায় এসে জনগণের মাঝে প্রশ্ন জেগেছে দেশে হচ্ছেটা কী।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে এ সরকার গঠন হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে সংস্কার ও গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠত করতে কিছু আলোচনার দ্বার খুলেছে সরকার। কিন্তু দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেনি। গ্রেফতার করা যায়নি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত বড় মাপের চিহ্নিত অপরাধীদের। বিচারকাজও ধীরগতিতে চলছে। এগুলো সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ।
নেতাদের অভিমত-জনগণ আশা করেছিলেন নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এ নিয়েও ধোঁয়াশার কারণে অনেকের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাড়া দেশের যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তা নিয়েও জনগণ উদ্বিগ্ন। বিশৃঙ্খলাকারীদের কাঠোরভাবে দমন করতে হবে। ছয় মাস একেবারে কম সময় নয়। অপরাধী, অপরাধীই-সেটা যে পরিচয়েই হোক। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পেশাদারের ভূমিকায় যুক্ত করা দরকার। এছাড়া এখন জরুরি নির্বাচনের পথে হাঁটা। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দিলে জনগণও নির্বাচনমুখি হবে, সেক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডার সঙ্গে সংলাপ দরকার। এই ফেব্রুয়ারিতেই আলোচনার মাধ্যমে যদি নির্বাচনের রোডম্যাপ সুস্পষ্ট করা যায়, তাহলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা বাড়বে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশররফ হোসেন এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, এই ছয় মাসে সরকারের কাছে জনগণ প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনগণ আশা করেছিল ,গত ১৫ বছর ধরে যারা অন্যায়-অনাচার, হত্যা-গুম-খুন, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার করেছে তাদের বিচার হবে। কিন্তু এর কিছুই এখনও দৃশ্যমান হয়নি। তারপর গত ১৫ বছর ধরে যারা তৎকালীন আওয়ামী সরকারকে খারাপ পথে পরিচালিত করেছে, তারা অনেকেই ক্ষমতার সঙ্গেই আছে এবং নানা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। এই সরকার তাদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারেও সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এসবই জনগণের কাছে হতাশার কারণ। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা প্রথম থেকেই সরকারকে বলেছি কী কী সমস্যা হতে পারে। ১৫ বছর ধরে একটি স্বৈরাচার সরকার গায়ের জোরে ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তারা হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে তারা ষড়যন্ত্র করতে চেষ্টা করবে। এ থেকে রক্ষার জন্য দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেবে, ততই সরকার ও দেশের জন্য মঙ্গল। বিশেষ করে নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা হলেই জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে, এর মধ্যে হয়ে যেত। সেটা হলে এখন যে ধরনের ষড়যন্ত্র প্রকাশ পাচ্ছে, এগুলো কিন্তু জনগণ নিজেদের স্বার্থে মোকাবিলা করত।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। তার আলোকে এ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃখকষ্ট, আত্মত্যাগ, আন্দোলন-সংগ্রাম আছে। এখন মানুষের প্রত্যাশা বেশি। সরকার যেসব কাজ হাতে নিয়েছে, কোন পর্যায়ে কতটুকু তারা করছে, তা জনগণ দেখবে। আমরা আশাবাদী, সরকার যৌক্তিক সময়ে সংস্কার ও নির্বাচন করতে পারবে।
ইসলামী আন্দোন বাংলাদেশের মহাসচিব হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহম্মেদ বলেন, আস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকার গঠন হয়েছিল। তাদের চেষ্টা ও উদ্যোগ ভালোই ছিল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও অস্থিরতার কারণে কোনো কোনো জায়গায় হয়তো বেগ পেতে হয়েছে। যা আশা করেছিলাম, কিছুটা হয়তো ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। সরকার আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে এটিই বিশ্বাস করতে চাই। তাই পুরোপুরি সফলও বলা যাবে না, ব্যর্থতাও বলা যাবে না।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার একটি অসাধারণ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত এই সরকারের প্রতি মানুষের বিপুল প্রত্যাশা থাকে। অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দেশের ভেতরে ও বাইরে বহু ধরনের তৎপরতা ছিল। ভারতের একটি অভ্যুত্থানবিরোধী তৎপরতা মোকাবিলা করতে সরকার দৃঢ়তার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে গণত্যার বিচারের কাজটা শুরু করেছেন। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটা খুবই ঢিমেতালে চলছে। হত্যাকাণ্ড অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশই গ্রেফতার হয়নি। এটা একটা দুর্বলতা। অর্থনীতিতে এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কমিশন বা উদ্যোগ দরকার ছিল তা দৃশ্যমান নয়। আবার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে কোনো দল গঠন করা হলেও তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন দেখা দেবে। এ নিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতার বিষয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এক ধরনের সামাজিক নৈরাজ্য, বিচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি এখনো দেখা যাচ্ছে। গত দুদিনে শেখ হাসিনার একটি উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে ঘটনা, সেটা প্রমাণ করছে সরকার কার্যকর নেই। এ ধরনের নৈরাজ্যে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে কিনা জনমনে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোনেন প্রিন্স বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে ব্যাপক জনসর্থনের মধ্য দিয়ে গঠিত এই সরকার। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল, একটা পূর্ণ গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নেবে, আরেক হচ্ছে জনজীবনের স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে। এটা জনগণের আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু খুবই ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ছয় মাসে জনজীবনেই তো স্বস্তি দিতে পারল না সরকার। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, চুর-ডাকাতি বেড়ে গেছে। সরকার স্বস্তি দিতে পারিনি শুধু নয়, স্বস্তির পথও দেখায়নি। ছয় মাস কিন্তু অনেক সময়, সরকারের দরকার ছিল প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গত ছয় মাসে সরকারের কাজের মূল্যায়ন করলে আমরা দেখি; দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে তাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য পর্যায়ের নয়। অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা করলেও দ্রব্যমূল্যসহ নানা বিষয়ে জনগণ সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করলেও, গতি মন্থর।
সংস্কার কমিটিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সরকার কাজ শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনও তাদের পরিকল্পনামাফিক কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ ৬ মাসের পারফরম্যান্স যদি আমরা মূল্যায়ন করি তাহলে সরকারকে আমি ১০০ তে ৪০ নম্বর দেব। সামনে রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কার ও নির্বাচনের চেয়েও জীবনমান নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশি। গত ছয় মাসের সমস্যাকে মানুষ বড় করে দেখবে না যদি আগামী ছয় মাসে সরকার আশানুরূপ ভালো করতে পারে। আমি আশা করি সরকার সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেবে।