যশোরের ছেলে রাশিয়ার যোদ্ধা- খবরটি চাউর হওয়ায় গোটা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেশীসহ স্থানীয়রা ভিড়
করছে জাফরের বাড়িতে। নানা প্রশ্নে জর্জরিত করছে পরিবারকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যশোরের কৃষক জাফর একজন সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি কয়েকবার অ্যাটাকে অংশগ্রহণ করেছেন। রাশিয়ার সৈনিকের পোশাক পরা একাধিক ছবি পরিবারের কাছে পাঠিয়ে সে দেশে ফেরার ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে সুদূর রাশিয়া থেকে সে কীভাবে রক্ষা পাবে, কীভাবে দেশে ফিরবে তা নিয়ে পরিবারের উদ্বেগের শেষ নেই।
যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের বড় মেঘলা গ্রামের খায়রুল সরদারের ছেলে জাফর হোসেন (৩৫)। ৪ মাস আগে উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। ইচ্ছা ছিল ইউরোপে গিয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবেন। হাসি ফোটাবেন পরিবারের মুখে। কিন্তু বিধিবাম। জাফর হোসেনের আর ইউরোপ যাওয়া হয়নি। এর আগেই দালাল চক্র তাকে রাশিয়ার আরেক দালালচক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে সে দেশে গিয়ে তাকে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নামতে হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে। জাফরের স্ত্রী খাদিজা খাতুন জানান, গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বহু চেষ্টা করেও স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি খাদিজা। হঠাৎ করে চার মাস পর জাফর পরিবারকে ফোন করে জানান, বাংলাদেশের দালাল চক্র তাকে রাশিয়ার আরেক দালালচক্রের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। ওই চক্রটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে যেতে বাধ্য করছে। প্রশিক্ষণে যেতে না চাইলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। মারধর করছে এমনকি খাবার দেয়াও বন্ধ করে দিচ্ছে।
জাফরের মা হাসিনা খাতুন বলেন, চার মাস আগে এনজিও থেকে ৪ লাখ ও সুদ করে ৩ লাখ এবং স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে ১ লাখ, মোট ৮ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে রাশিয়া পাঠাই। দালাল চক্র প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তার ছেলেকে সৌদিতে একমাস রাখে, এরপর দুবাই থেকে নতুন দালাল তাকে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাশিয়ায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধের ময়দানে নামতে হবে বলে ছেলে তাকে জানিয়েছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, এখন আমার ছেলে যুদ্ধের ময়দানে কান্নাকাটি করছে। সে জানিয়েছে, যুদ্ধ করতে গিয়ে বাংলাদেশি একজন মারা গেছে। আরেকজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। আমার ছেলে এখন বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইছে। না হলে তার মৃত্যু হবে বলে জানিয়েছে। সরকারের কাছে বুকের মানিককে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন অসহায় মা হাসিনা।
জাফরের স্ত্রী খাদিজা খাতুন বলেন, সাইপ্রাস যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকার ড্রিম হোম ট্রাভেলসে টাকা জমা দিয়েছিলেন তার স্বামী জাফর। কিন্তু সাইপ্রাস না পাঠিয়ে ছলচাতুরি করে তাকে প্রথমে সৌদি, তার পরে দুবাই ও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় পাঠিয়েছে এজেন্সিটি। ভাগ্য বদলের আশায় দেশ ছেড়ে এখন যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে জাফরকে। যুদ্ধ না করলে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে তাকে। তিনি স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।
এদিকে বাড়িতে এ খবর পৌঁছানোয় পাওনাদাররা টাকা ফেরত পেতে নানাভাবে জাফরের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন বলে জানান তার মা হাসিনা। কূল-কিনারা হারিয়ে পরিবারটি অথৈ সাগরে পড়ে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। ঢাকার ড্রিম হোম ট্রাভেলসের সবগুলো যোগাযোগ নম্বর বন্ধ পাওয়ায় পরিবারটি এজেন্সির সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছেন না। এদিকে পিতার এমন বিপদের খবরে জাফরের দুই পুত্র ও এক শিশু কন্যার চোখের পানি থামছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় মানব পাচারের একটি বড় ফাঁদ রয়েছে ড্রিম হোম ট্রাভেলস নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের। গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্তরে তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় প্রতিটি পয়েন্টে এই চক্রের সদস্যরা কাজ করে। এরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বেকার যুবকদের সংগ্রহ করে টাকার বিনিময়ে রাশিয়ার দালালদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। রাশিয়া এসব অসহায় যুবকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে পাঠাচ্ছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে।