Image description
 

ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির বড় এবং মধ্যম সারির অনেক নেতা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে দলটির প্রধান পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাও অবস্থান করছেন ভারতে। ফলে কার্যত ভারতে বসেই আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

 

সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে এখন দেশের অভ্যন্তরে থেকে যাওয়া আওয়ামী লীগের কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বিদেশে বসেই এই চেষ্টা চালাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির কয়েকজন নেতা।

কতজন আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে রয়েছেন? কীভাবে তারা যোগাযোগ করছেন নিজেদের মধ্যে? এসব প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগ নেতার কাছে থেকে খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।

কে কোথায় আছেন?

 

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ভারতে পালিয়ে চলে আসেন। এটা এখন একটা ‘ওপেন সিক্রেট’ অর্থাৎ সবারই জানা– অথচ কেউ তা খোলাখুলি বলেন না।

দলের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলছিলেন, এটাকে ঠিক পালিয়ে আসা বলা যায় না। কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে আমরা আত্মগোপন করে আছি।

আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা ভারতে অবস্থান করছেন, তাদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে আছেন। কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়, কেউ দিল্লিতে, কেউ আবার ত্রিপুরায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন বলে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে। তবে ইউরোপ সহ অন্যান্য দেশেও আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ অবস্থান করছেন। এদের কেউ পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে আসার পরেই চলে এসেছেন ভারতে, কেউ আবার কয়েক মাস পরে এসেছেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে প্রথম সারির বা ‘ক্যাটেগরি ১’ নেতাদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন পশ্চিমবঙ্গে বাস করছেন।

এই শ্রেণির নেতাদের মধ্যে যেমন আছেন দল এবং সাবেক সরকারের শীর্ষ পদাধিকারী এবং মন্ত্রীরা, তেমনই আছেন প্রায় ৭০ জন সংসদ সদস্যও।

বাকিদের মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের অনেক জেলা সভাপতি-সম্পাদকরা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাও।

আ. লীগের এক নেতা বলছিলেন, এদের বেশিরভাগই নেতা। নেত্রী এবং নারী কর্মীরা খুবই কম আছেন এখানে। আবার অধিকাংশেরই পরিবার এখানে নেই।

পশ্চিমবঙ্গে ‘ক্যাটেগরি ১’ নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও উপজেলা স্তরের সভাপতি-সম্পাদক, জুনিয়র এবং কম গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের সংখ্যাটা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি বলে জানা যাচ্ছে। ভারতের বাইরে ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশেই আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা আছেন।

যেভাবে দেশ ছেড়ে ভারতে

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে কে কীভাবে বাংলাদেশ ছেড়েছেন, তা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিবিসির কাছে উল্লেখ করেছেন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। তবে তারা সেই যাত্রাপথ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলতে চাননি।

তবে ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সি ও গোয়েন্দা সূত্রগুলোর কাছ থেকে বিবিসি আগেই জানতে পেরেছিল যে মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়েই পাঁচ আগস্টের পরের কয়েকদিন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে এসেছিলেন।

পেট্রাপোল বেনাপোলের মতো দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত চেকপোস্টগুলো কিছুটা এড়িয়েই চলা হয়েছে, কারণ ওই সীমান্তগুলো খুবই জনপ্রিয় এবং বহু মানুষের যাতায়াত থাকে সেগুলোতে।

আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ বলছিলেন, আগস্টের পাঁচ তারিখের পরেই আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। ফোনও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে আমি দেশেই ছিলাম। অক্টোবর মাসে আমি দেশ ছাড়ি। ঠিক কোন সীমান্ত দিয়ে আমি বেরিয়েছি, সেটা বলব না। কিন্তু পাহাড়, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভীষণ কষ্টকর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে। কয়েকটা শহর ঘুরে বর্তমান স্থানে রয়েছি আমি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম অবশ্য আগস্টের ১০ তারিখেই দেশ ছেড়েছেন, তার আগে কয়েকটা দিন তিনি দেশে আত্মগোপন করেছিলেন।

তার কথায়, বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে ভারতে আসতে সর্বোচ্চ কত সময় লাগতে পারে – আট, নয় ঘণ্টা? আমার সময় লেগেছে দুইদিন – ১০ তারিখ রওনা হয়ে আমি সীমান্ত পেরই ১১ তারিখ। খুব গোপনে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছই আমি। তবে সেখানে আমাকে কেউ চিনে ফেলতে পারে, এই আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় অন্য এক সীমান্তে যেতে হয়। এই ভয়ও ছিল যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা তো আমাকে চেনে না – কাঁটাতারের বেড়া পেরনোর সময়ে যদি গুলি চালিয়ে দেয়!

এভাবেই নানা সময়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতে বা অন্য কোনো দেশে ‘আত্মগোপন’ করে রয়েছেন।

ভারতে কেন?

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা দিল্লিতে আছেন পাঁচ আগস্ট থেকে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিমান তাদের নিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে হিন্দোন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছিয়ে দেয়।

শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে সব সময়েই একটা অভিযোগ উঠে এসেছে তার সঙ্গে ভারতের বিশেষ সখ্যতা থেকেছে। তাই তিনি দেশত্যাগের পরে যে প্রথমে ভারতেই আসবেন, এটা কিছুটা স্বাভাবিক। তবে অন্য কোনো দেশে যে তিনি যাবেন না, দিল্লিতেই থেকে যাবেন আপাতত, এটা অনেকেই আন্দাজ করেননি হয়তো।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলছিলেন, নেত্রী নিরুপায় হয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। একটা চক্রান্তকারী, অশুভ শক্তি তাকে ভারতে যেতে বাধ্য করে। আবার ভারতই আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বন্ধু রাষ্ট্র। খুব কম সময়ে আমাদের দেশ থেকে এখানে এসে বসবাস করা যায়।

যেভাবে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ

ভারত এবং অন্যান্য দেশে যে সব আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপন করে আছেন, তাদের মূল যোগাযোগের মাধ্যম এখন হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামের মতো নানা ডিজিটাল মাধ্যম।

তবে যারা কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় আছেন, নিয়মিতই তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় – একে অন্যের বাসায় যান। আর সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ হয় মূলত ডিজিটাল মাধ্যমে, জানাচ্ছেন আত্মগোপনে থাকা একাধিক নেতা।

সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, আজকের ডিজিটাল যুগে কে কোথায় থাকল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ডিজিটাল যোগাযোগ এতটাই উন্নত হয়ে গেছে যে একই সঙ্গে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়।

তিনি বেলজিয়ামে বসবাস করছেন বলে জানা গেলেও বাংলাদেশ থেকে তিনি সেদেশে কীভাবে গেলেন, তা জানা যায়নি।

আত্মগোপনে থাকা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রামে অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে নানা স্তরে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। উপজেলা, জেলা ভিত্তিক এবং জাতীয় স্তরে, সহযোগী সংগঠনগুলোর নানা স্তরে যেমন গ্রুপ আছে, তেমনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক-বিহীন এরকম নামেও গ্রুপ রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের নেতা-কর্মীরা যেমন পোস্ট করছেন, তেমনই নানা নির্দেশ যাচ্ছে ‘আত্মগোপনে’ থাকা নেতৃত্বের তরফ থেকে।

ওইসব গ্রুপগুলোতে নিয়মিত ‘ভয়েস চ্যাট’ও হয়, মতামত বিনিময় করেন নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ, সেসব কেমন ভাবে চলছে বাংলাদেশের নানা এলাকায়, সেই সব ছবি– ভিডিও ওই গ্রুপগুলোতে নিয়মিত শেয়ার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

আবার কোন এলাকায় কোন আওয়ামী লীগ নেতার ওপরে হামলা হলো বা কাকে গ্রেফতার করল পুলিশ, সেই সব তথ্যও গ্রুপগুলোতে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আত্মগোপনকারী কয়েকজন নেতা।

আত্মগোপনকারী আওয়ামী লীগ নেতা পঙ্কজ নাথ বলছিলেন, হতে পারে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড আছি, ডিজিটাল মাধ্যমেই কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বাধ্য হচ্ছি, কর্মসূচি ঘোষণা করতে হচ্ছে ফেসবুকে। কিন্তু এই ফেসবুকে কর্মসূচি ঘোষণা করাতেই তো অবৈধ সরকারের পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে দেখি!

শেখ হাসিনার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ?

আওয়ামী লীগের যে কয়েকজন নেতার সঙ্গে বিবিসি বাংলা কথা বলতে পেরেছে, তারা সকলেই বলেছেন যে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তবে তাদের মধ্যে কারও সঙ্গে শেখ হাসিনার দেখা হয়েছে কী না, তা জানা যায়নি।

আত্মগোপনকারী নেতারা বিবিসিকে বলেছেন যে তিনি নিয়মিতই নেতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে সাধারণ কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন।

একজন নেতা বলছিলেন, শেখ হাসিনাকে অ্যাপের মাধ্যমে মেসেজ করে রাখলে তিনি তার সময়-মতো উত্তর দেন।

আবার নানা সময়ে তাকে ফেসবুক লাইভে আসতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও তিনি যোগ দিয়ে নানা নির্দেশ দেন বা বক্তব্য তুলে ধরেন। তবে এখনও পর্যন্ত শেখ হাসিনা যত ভাষণ দিয়েছেন, তার সবই অডিওতে। পাঁচ আগস্টের পর থেকে তার ভিডিও এখনও দেখা যায়নি।