রোববার একদল শিক্ষার্থী নিজেদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যোদ্ধা পরিচয় দিয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় উপস্থিত হন। তাদের মধ্য থেকে কাজী জুবায়ের, সৈয়দ সামিউল ইসলাম, মো. আজাদ ও মাহতাব খান বাঁধন নামে চার শিক্ষার্থী বাদী হয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি চাঁদাবাজির লিখিত অভিযোগ করেন। ওসি বরাবর করা ওই অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন- আকাশ, লাবিব মুহাম্মাদ, রাজু আহমেদ আসিফ, বাপ্পি খান, ওয়েস রহমান, নাহিদ শিকদার, আসিফুল রবিন, সাকিব ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর থেকে নিজেদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন এলাকায় বিভিন্ন প্রকারের বিশৃঙ্খলা এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। বর্তমানেও তারা নির্দ্বিধায় এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, প্রতারণা এবং হুমকি দেয়ার মতো নিকৃষ্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তারা জড়িত। তাদের দ্বারা সমাজের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা যখন আমাদেরকে এসব জানায়, তখন আমরা উক্ত অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে কাজ শুরু করি। তবে সমাজের ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ডাকে এবং তাদের উপকারে আমরা যখন এগিয়ে আসি তখন ওই দুষ্কৃতকারীরা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এমতাবস্থায় আমরা খুবই ভীত ও জীবন সংকটে রয়েছি।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই মঙ্গলবার বিকালে উত্তরা-১৩ নম্বর সেক্টরের গাউসুল আজম অ্যাভিনিউ সড়ক থেকে আইইউবিএ’র শিক্ষার্থী আসিফুল হক রবিন, উত্তরা টাউন ডিগ্রি কলেজের আকাশ ও গাজীপুরের বিএএসটির শিক্ষার্থী বাপ্পিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আবু সাঈদের নেতৃত্বে একটি দল। পূর্ব থানায় অভিযোগ জমা হওয়ায় আটকের পর তাদেরকে উত্তরা পূর্ব থানায় হস্তান্তরের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে ছাত্রদের আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তরার অন্য শিক্ষার্থীরা পূর্ব থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা মহাসড়ক অবরোধ করে। তখন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আটক শিক্ষার্থী ও তাদের সঙ্গীদের নিয়ে উত্তরা পূর্ব থানার কম্পিউটার ল্যাব রুমে আলোচনায় বসেন পূর্ব-পশ্চিম দুই থানার ওসি, ইন্সপেক্টর, উত্তরা জোনের এডিসি, এসিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বৈঠক শেষে আটক শিক্ষার্থীদের থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের আটক করে থানায় নিয়ে আসা উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আবু সাঈদকে ক্লোজ করার তথ্য জানানো হয়। উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বিরুদ্ধেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও বৈঠক শেষে একটি লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। সেসব অভিযোগও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন ছাত্র-পুলিশের বৈঠক চলছিল তখন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাও করে স্লোগান দেন এবং আটকদের ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান। এরপর তারা উত্তরার সড়ক অবরোধ করে রাখেন। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে শতাধিক শিক্ষার্থী উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা চালান। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা থানার সাইনবোর্ডও ভাঙচুর করেন। তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে থানার জানালা দরজার কাঁচ ভেঙে যায়। শিক্ষার্থীদের হামলায় উত্তরা পশ্চিম থানার এএসআই মহাদেবসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। গতকাল সরজমিন গিয়েও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের ছোড়া ইটের আঘাতে ভাঙা থানা ভবনের ২য় তলার জানালার কাঁচ এখনো সেই অবস্থাতেই রয়েছে। থানায় হামলা চালানো সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, থানার গেটের সামনে দাঁড়ানো এসআই মহাদেবকে কিল-ঘুষি মারছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
হামলার বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাজমুল হাসান বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওই তিন শিক্ষার্থীকে আটক করে আমাদের থানা পুলিশ। অভিযোগ যেহেতু উত্তরা পূর্ব থানায় তাই আটকের পর ওই শিক্ষার্থীদের পূর্ব থানায় হস্তান্তর করতে যায় আমাদের থানা পুলিশ। আমরা তাদেরকে নিয়ে বৈঠকে বসি। বৈঠক চলছিল সবকিছু সুরাহাও হয়ে গিয়েছিল। এরই মাঝে শিক্ষার্থীদের একটি দল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর প্রথমে উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাও করে। পরে আমাদের উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা চালায়। রাতে সেনাবাহিনীর দুটি টিম ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তিনি বলেন, যেকোনো থানায় অভিযোগ হলে অন্য থানা এলাকায় যদি সেই আসামি বা অপরাধীরা অবস্থান করে তখন সেখান থেকে তাদেরকে আটক করে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়। আমরাও সেটাই করেছি। এর প্রেক্ষিতে যদি আমাদের থানায় এভাবে হামলা চালানো হয় তাহলে আমরা কাজ করবো কীভাবে?
এদিকে শিক্ষার্থীদের আটক ও তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগের বিষয়ে উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শামীম আহমেদ বলেন, উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশই বলতে পারবে, তারা কেন আটক করেছে। আটকের পর কেন তারা আমাদের থানায় দিয়ে গেছে, সেটাও আমরা জানি না। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসিই বলতে পারবেন, কেন তিন ছাত্রকে তারা আটক করেছেন। থানায় হামলার বিষয়ে ওসি বলেন, আমার থানার সামনে মিছিল হয়েছে কিন্তু কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই। তবে সরজমিন উত্তরা পূর্ব থানায় গিয়ে থানা ভবনের বেশ কয়েকটি জানালার কাঁচ ভাঙা দেখা যায়। একইসঙ্গে উত্তরা পূর্ব থানার ওসি তদন্ত করে বলেন, গত তিনদিন আগে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে ওই চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়েছিল। যার বাদী ছিল চারজন। বিষয়টি নিয়ে মামলা না হলেও তারা একটি লিখিত অভিযোগ দেয়। যার যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন আমাদের পূর্ব থানার এসআই শরিফ লিটন। সেই তথ্যের যাচাই করার আগেই এই হামলার ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আহম্মদ আলী মানবজমিনকে বলেন, উত্তরা পূর্ব থানার ওসি’র এমন বক্তব্যের কোনো সুযোগ নেই। উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের করা একটা অভিযোগের প্রেক্ষিতেই ওই দিন শিক্ষার্থীকে আটক করে হস্তান্তর করে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ সদস্যরা। এরপরও শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এবং তিন শিক্ষার্থীকে থানায় আটক করে নিয়ে আসায় উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আবু সাঈদকে ক্লোজড করা হয়েছে। অপরদিকে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি’র বিরুদ্ধেও বেশ কিছু অভিযোগ করেছে তারা, সেগুলো আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের পর ডিএমপি কমিশনার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে আটক হওয়া ওই তিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকা আইইউবিএ’র শিক্ষার্থী আসিফুল হক রবিন বলেন, সেদিন বিকালে আমরা ১৩ নম্বর সেক্টরের একটি রেস্টুরেন্টে উত্তরার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তালিকা করছিলাম। ওই সময় উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আবু সাঈদ সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাদের সকলের এক এক করে নাম জিজ্ঞেস করে। পরে আমাদের তিনজনকে থানায় নিয়ে যায়। তখন আমরা তাদের কাছে আটক হওরার কারণ জানতে চাইলে এসআই সাঈদ বলেন, আমাদের নামে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওসি বলেছে, ডিসি স্যার আপনাদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর আমাদেরকে উত্তরা পূর্ব থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর যখন আমাদেরকে উত্তরা পূর্ব থানায় নিয়ে যাওয়া হলো, তখন সেখান থেকে বলা হয়- আমাদের নামে কোনো মামলাই নেই। রবিন বলেন, আমরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সদস্যদের, চোর-ছিনতাইকারীদেরকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিই। কিন্তু সেই ক্রেডিট নেয় উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি হাফিজুর রহমান। আবার সেই ওসিই আমাদেরকে আটক করতে পুলিশে পাঠায়। আমরা তার বিচার চাই। থানায় হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, বেশ কিছু লোকজন মুখে মুখোশ পরে থানায় হামলা চালিয়েছে। আমাদের লোকজন উল্টো হ্যান্ড মাইক নিয়ে তাদেরকে ভাঙচুর চালাতে নিষেধ করে।
এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রওনক জাহান বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। পরবর্তীতে আমরা বসে একটি সুন্দর সমাধান করেছি। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে এসআই আবু সাঈদের এপ্রোচটা ভালো ছিল না। শৃঙ্খলা বহির্ভূত কাজ করায় তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।