বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের আজ ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দেশ ছাড়ার পর শুরু হয় রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তুতি। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বয়সও ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার পথে। এই ছয় মাসের মূল্যায়নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি।অন্তর্বর্তী সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। গত ২৯ জানুয়ারি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করে। তবে হাসিনা সরকার আমলের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। আর এ বছর বাড়বে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বেলজিয়ামভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) কয়েক দিন আগে ‘বাংলাদেশ : গণতান্ত্রিক রূপান্তরে সংকটগুলো’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে।
সরকারের অর্থ বিভাগ আগেই জানিয়ে রেখেছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজ শুরু করতে হয় আগের সরকারের রেখে যাওয়া ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে।এর মধ্যে পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ৭৯০ কোটি ডলার। এই বিপুল ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ এখন বর্তমান সরকারের ঘাড়ে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের পর দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হতে থাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য। ফিন্যানশিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য উল্লেখ করে গণমাধ্যমে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যে শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে উন্নয়নের নামে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যার ৪০ শতাংশই লুটপাট করা হয়েছে।পর্যবেক্ষকমহলের মতে, আর্থিক খাতের আগের এই বিশৃঙ্খলা ছাড়াও এখনো একের পর এক বিভিন্ন সংগঠনের দাবি-আন্দোলন ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই সরকারকে।
মানবাধিকার পরিস্থিতি : মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে। তবে এই সরকারের সময়েও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা একেবারে বন্ধ হয়নি, যা খুবই অপ্রত্যাশিত।মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক এ এস এম নাসিরুদ্দিন এলান গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন নেই, এটাই বড় প্রাপ্তি। ৫ আগস্টের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কাজে ফেরাতে সময় লেগেছে। এখনো এই সংস্থার কাজ সন্তোষজনক নয়। নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা, এটা হওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা কমছে না। বিএনপির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এই সহিংসতা চলমান। গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দল ও সংগঠনের মধ্যে মতপার্থক্য অস্বাভাবিক নয়। তবে এসব দল ও সংগঠন এখনো ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।আসছে নতুন দল : জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ মাসেই আসতে পারে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল। দলের নাম এখনো চূড়ান্ত না হলেও দলের নেতৃত্বে কারা আসছেন তা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এই দলের আহ্বায়ক হচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র আভাস দিয়েছে। সদস্যসচিব এবং অন্যান্য শীর্ষ পদে কারা থাকবেন তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ছয় মাস আগে ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যে বিপ্লব হয়েছে তার মাধ্যমে দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মানুষের বাকস্বাধীনতা ছিল না, সেই স্বাধীনতা মানুষ ফিরে পেয়েছে। মানুষ এখন মুক্ত আকাশে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকায় মানুষের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। ন্যায়বিচার পেয়ে মানুষ কারামুক্ত হচ্ছে। এগুলো নিঃসন্দেহে বড় পরিবর্তন। তবে ছয় মাস পরও দেশে গণতন্ত্র ফেরেনি। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের পরিধি এত বিস্তৃত করে ফেলেছে যে কোনো কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে না। এখন সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তাহলে বিদ্যমান যে সংকট তা কাটিয়ে তুলতে পারবে নির্বাচিত সরকার।জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা, ভূখণ্ড ও পতাকা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল এখনো পায়নি। তবে দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্টের পর একটি পথ রচিত হয়েছে। মানুষ এখন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে, চলাফেরা এবং একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। নির্যাতন, জুলুম থেকে রক্ষা পেয়েছে। ৫ আগস্টের বিপ্লবের প্রকৃত সুফল পেতে হলে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন না হয়ে আদর্শিক পরিবর্তন হতে হবে। জুলুম, চাঁদাবাজি ও অন্যায়ের শাসনের পরিবর্তন হতে হবে। নইলে যা হবে তা শুধু মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এটা হলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি ট্র্যাজেডি।
গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা অস্থির সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার যে ছয় মাস টিকে আছে, এটাই বড় সাফল্য বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, এই সময়ে সরকারকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার পরও সরকার সংস্কারসহ বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছার উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণের বিরাট প্রত্যাশার চাপ নিয়ে সরকার পরিচালনায় নানা ঘাটতি ও দুর্বলতা থাকলেও দেশের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে।সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি না থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, শ্লথগতি, নানামুখী চাপ, সরকার পরিচালনায় অনভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, সরকারের কিছু কাজে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ প্রশাসনকে এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ফলে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে যেভাবে ফিরতে চাচ্ছে, তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ দল না হলেও অপকর্ম সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ও আত্মসমালোচনা জনগণ জানতে চায়। সেটা জনগণের কাছে আগে স্পষ্ট করতে হবে। অনেক টানাপড়েন সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী দুঃশাসনের অবসানের পর জনমনে অনেক আকাঙ্ক্ষার জন্ম হলেও তা পূরণ হয়নি। ফ্যাসিবাদের পতনের পর জনমনে স্বস্তি এলেও গত ছয় মাসে বাজারমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি জনজীবনকে অস্থির করে তুলেছে। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়নি। এ কারণে এখনো তারা মাঠে নামছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে কোনো কমিশন হয়নি। জনগণ এখন সন্দেহ করতে শুরু করেছে, এই সরকারের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা হচ্ছে কি না। এই সন্দেহ ও বিভ্রান্তি এড়ানোর দায়িত্ব সরকারের। এ জন্য আমরা বলেছি, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন তা শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে আগামী দিনে নির্বাচিত সরকার উদ্যোগ নেবে।’সংস্কারে পরিবর্তন আর্থিক খাতে : ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরেই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে আর্থিক খাতে। আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে বাংলাদেশ ব্যাংক পায় একজন নতুন গভর্নর। এরপর বিধ্বস্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধ, মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ আরো কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে খুব শিগগির আরো ইতিবাচক ফল আসবে বলে আশাবাদী গভর্নর।
ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি : চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে মোট দুই হাজার ৮৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এই রপ্তানি এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৬৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দুই হাজার ৫৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছিল।কমেছে মূল্যস্ফীতি : গত মাস জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৯.৯৪ শতাংশে। আগের মাসে ছিল ১০.৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৭২ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ১২.৯২ শতাংশ। টানা তিন মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি কমছে।অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আপাতত আমাদের মূল মনোযোগ মূল্যস্ফীতির দিকে, যতটুকু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মূল্যস্ফীতিটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করব। এ জন্য আরো দু-তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। এখন আমরা যে উদ্যোগটা নেব, সেটার প্রভাব বাজারে দেখতে পারবেন। জুন মাসের দিকে মূল্যস্ফীতিতে একটা আইডল ৬ বা ৭ শতাংশে যেতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য বেটার হয়।’রেকর্ড রেমিট্যান্স : চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে দেশে এক হাজার ৫৯৬ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৯১ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০৫ কোটি ডলার। সাত মাসে এত রেমিট্যান্স আগে কখনো আসেনি।