তারিখের হিসাবে আজ ৬ মাস। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার দম্ভের পতনের দিন। ৫ আগস্ট প্রতাপশালী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারত চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। শত শত প্রাণের বিনিময়ে আর আহতদের কাতরানোর শব্দে যখন বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, তখন ছাত্র-জনতার বিজয়ের পতাকা ওড়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় হলেও রাষ্ট্র সংস্কার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখনো চলমান। গত ছয় মাসে অন্তর্বর্তী সরকার জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ফলপ্রসূ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত বিজয় আসবে তখনই, যখন দেশে আইনের শাসন ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন ঘটবে।
বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলন দানা বেঁধেছিল গত বছর জুলাই মাসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনে সহিংসতার জেরে ওই মাসের মাঝামাঝি সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনের প্রবল ধাক্কায় ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ তিন দিন সরকারবিহীন থাকার নজিরবিহীন ঘটনার পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরে। তার আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় দ্বাদশ সংসদ। প্রশাসনে অস্থিরতা, ‘বঞ্চিত’ পেশাজীবী শ্রমজীবীদের বিক্ষোভের মধ্যে সংস্কারে উদ্যোগী ও ঐক্যের সন্ধানের মধ্য দিয়েই পেরিয়ে গেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এই ছয় মাস।
দিন দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার বিএনপি মনে করে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে দেড় দশক কর্তৃত্ব করা বিগত সরকারের ‘দোসরদের ষড়যন্ত্র’। নির্বাচন যত দেরি হবে, এমন সমস্যা তত বাড়বে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের উদ্যোগে নাগরিকদের নিয়ে গড়া জাতীয় নাগরিক পরিষদ সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে আগে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন চায়। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কবে হবে, দেশের পরবর্তী অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা জানতে আগ্রহী হয়েছে উঠেছে সাধারণ মানুষও, যারা বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি আর বেকারত্বের চক্করে পড়ে নাজেহাল।
‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে অক্টোবর-নভেম্বরে ১০টি কমিশন গঠন করে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও নির্বাচন পাশাপাশি চলার কথা বললেও সংস্কারের জন্য নির্বাচন যাতে ‘বিলম্বিত’ না হয়, সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নজর দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের জন্য দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার না চাইলে চলতি বছরের শেষের দিকে আর সংস্কার শেষ করতে দিলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তবে আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনাসহ যে নানা প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল ছয় মাস পর এসে এর অনেকগুলোতেই তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। তবে সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যেও তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফল আগামী তিন মাসের মধ্যেই পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের পক্ষ থেকে যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে, সেটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও প্রতিবার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। গণঅভ্যুত্থানের এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সরকার। পরে এই তালিকায় নতুন আরও চারটি কমিশন স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যুক্ত করা হয়। গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন জমা পড়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন আজ বুধবার জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার পড়ে, সেগুলোর একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। গত শনিবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজারে চলমান মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে স্বীকার করে বলেছেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে সরকার ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।’
গত ৮ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ঊর্ধ্বমুখী জানিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী ও দিনমজুরদের ওপর চাপ বাড়ছে। মধ্যবিত্তরাও চাপে আছেন। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যেটুকু কমেছে, এটি কিন্তু কম বলা যায় না। মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তিই আছে। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গত মাসে বলেছেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত, নিজে বাজার করে খাই। আমি নিজেও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছি। রিজার্ভের প্রথম চার মাস ভালো অর্জন দেখালেও গেল মাসে কমেছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগের মাসে এসেছিল রেকর্ড ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।’
গত ৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করেন। শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ এক না। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বাংলাদেশের মতো এত খারাপ অবস্থায় যায়নি। বাংলাদেশের মতো হলে তো শ্রীলঙ্কাকে আর খুঁজেই পেতাম না।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছিল এ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তাও জানিয়েছে সরকার। ৫ আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। আবার এটাও বাস্তবতা, ৫ আগস্টের পর হামলার শিকার পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাগুলোর সব কটি এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে পুলিশ বাহিনী যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, সেটিও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামায় সরকার। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও জনমনে আতঙ্ক রয়েই গেছে। পল্টন, শান্তিনগর, মগবাজার, মোহাম্মদপুরের একাধিক বাসিন্দা জানান, ‘সন্ধ্যার পর আর কেউ বাইরে থাকতে চান না।’
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, গত পাঁচ মাসে গণপিটুনিসহ মব জাস্টিসের মতো ঘটনায় সারা দেশে অন্তত ৭০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। এ সময় কমপক্ষে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এখনো।
নির্বাচন ও ঘোষণাপত্র ইস্যুতে বিএনপি ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের মুখোমুখি অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।
পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সম্প্রতি এক লেখায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক জানিয়েছেন, ‘সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি সাক্ষাৎকার ঘিরে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী নেতার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির সঙ্গে তাদের মুখোমুখি অবস্থান স্পষ্ট হয়।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাক্ষাৎকারে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন না হলে তারা মানবেন না। জবাবে উপদেষ্টা নাহিদ বলেছেন, বিএনপি আরেকটি ১/১১-এর মতো সরকার চায়। বিএনপি এও বলেছে, নির্বাচিতদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ওই নির্বাচিত সরকার সবাইকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপির এসব প্রস্তাব ছাত্রদের পছন্দ হয়নি। তিনি আরও জানান, বিএনপির বিরুদ্ধে ছাত্র ও জামায়াতপন্থিদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি বাধা দিয়েছে। কিন্তু সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে দেখা যায়নি। গণহত্যার বিচার এই ছয় মাসে কত দূর এগোল? সারা দেশে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ঘুরে বেড়ান, তাদের আটক করে না। ছয় মাস বিচারের জন্য খুব কম সময় নয়। ছাত্ররা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিএনপিকে দোষারোপ করছে বটে, কিন্তু এর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যেহেতু সরকারের মধ্যে ছাত্রদের প্রতিনিধিও আছে।
বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত অক্টোবরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন ও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে। সর্বশেষ ৪ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ব্রিটিশ এমপি রূপা হকের সাক্ষাতের সময়ও প্রধান উপদেষ্টা জানান, ‘মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের জন্য আগামী দুই মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধীদের একধরনের বিপরীতমুখী অবস্থান রয়েছে। ফলে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে সরকার যেমন চাপে থাকবে, আবার ঘোষণা করা হলেও সরকারকে বিরোধিতার মুখে পড়তে হতে পারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছিলেন, ‘নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।’
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের আগামী মে-জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সম্ভব। ইতিমধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। এপ্রিল মে মাসের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবে। এ বছরের অক্টোবর নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করায় কোনো সমস্যা দেখছি না। আর চলতি মাসে বা মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে কী কী সংস্কার করা দরকার, তা শেষ করে একটা মতৈক্যের জায়গায় আসতে পারব।’
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ জানান, ‘ছয় মাস ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, আরও এক বছরের বেশি লাগবে, এটার তো কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। অবশ্যই এ বছরের মধ্যে নির্বাচনটা হতে হবে।’ ৩ জানুয়ারি রাজধানীতে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সংস্কারের কথা শব্দচয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, রাজনৈতিক দল ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয় সুনির্দিষ্ট করুন। অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে যেন না পারে, সেজন্য দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।’
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ করছে। তাদের সঙ্গে আছে আন্দোলনের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি। বিভিন্ন জেলায় তাদের নেতারা সভা-সমাবেশ করছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি চাইছে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন দরকার, তারপর নির্বাচন। সংগঠন দুটি বলছে, নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে, তাও আগে চূড়ান্ত করতে হবে। এসবের সঙ্গে ঘোষণাপত্র নিয়ে একাধিক মতানৈক্য রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো ও ছাত্রদের মধ্যে। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা গত মাসে বৈঠকও করেছেন। যার সুরাহা এখনো হয়নি।
সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জুলাই-আগস্টের ‘গণহত্যার’ বিচারের কথাও বলেছে। সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আটশর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মারা গেছে গুলিতে। হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যেই কয়েকশ মামলা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। ‘গণহত্যার’ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে সম্প্রতি অনুরোধও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়। এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তবে কেন সবাইকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ শুরু করা হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।
তবে নিজেদের অর্জনের কথা মোটাদাগে পাঁচটি ক্ষেত্রে হয়েছে বলে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন। সরকার মনে করে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন আনা, দেশের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি বেশখানিকটা উদ্ধার, সংস্কারকাজ পরিচালনায় ব্যাপকভাবে বিদেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়া, সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা এবং বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্পের সংকট ও অস্থিরতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে অর্জন দেখছেন তারা।
সবকিছু ছাপিয়ে গণঅভ্যুত্থানের আগে ছাত্র ও আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য হয়েছিল, তাতে জোর দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ড. ইউনূস। এই ঐক্যকে ধরে রেখেই তিনি এগিয়ে যেতে চান। গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় ঐক্যের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে সেই কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘যখন নিজেরা নিজেরা কাজ করি, তখন একটু দুর্বল মনে করি। আবার যখন সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তখন মনের মধ্যে সাহস বাড়ে, একতাবদ্ধভাবে আছি। আপনাদের (রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের) সঙ্গে দেখা হলে, বসতে পারলে খুব ভালো লাগে, মনে সাহস পাই। ঐক্যের মাধ্যমে করলে সবার মনে সাহস আসবে। সবাই ভাববে আমরা এখনো জেগে আছি। আমরা ভোঁতা হয়ে যাইনি, জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ আছি। আমি যত দিন আছি, একতা নিয়েই থাকব। কাজেই সে পথেই আমাদের চলতে হবে।’
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির চাপে থাকা সরকার আগামীতে দেশকে কোনদিকে বা কোথায় নিয়ে যাবেন, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন একাধিক বিশ্লেষক।