জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের শেষ মুহূর্তে। দলের নাম, প্রতীক, নীতি একং কর্মসূচি ঠিক করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উদ্যোক্তারা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ মাসের শেষ দশের যেকোনো দিন ঘোষণা আসবে। ২০ ফেব্রুয়ারি বা ২৩ ফেব্রুয়ারি দল ঘোষণার তারিখ নিয়ে এগোচ্ছেন ছাত্ররা। পুরো রমজান মাস অর্থাৎ পুরো মার্চ জুড়ে ইফতার মাহফিল, আলোচনা সভাসহ সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি থাকবে নতুন দলের।
তবে নামধামের বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও নতুন দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম থাকছেন বলে অনেকটাই চূড়ান্ত। তিনি দলের আহ্বায়ক হতে যাচ্ছেন এমনটাই আলোচনা। নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ দলের আহ্বায়কের বিষয়ে দেশ রূপান্তরের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নাহিদ ইসলামের বিষয়ে আলোচনাটা ইতিবাচক রয়েছে। তাকে ঘিরে আলোচনা হচ্ছে। জুনায়েদ জানান, আকর্ষণীয় কোনো কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটাতে চান।
জানা গেছে, এর আগে জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাড়ি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের শহীদ ওয়াসিমের বাড়ি পর্যন্ত লংমার্চের মধ্য দিয়ে দলের প্রথম কর্মসূচির কথা আলোচনায় ছিল। তবে সামনে রমজান ও ঈদ থাকায় সেই কর্মসূচি কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে। কারণ সেই কর্মসূচি ১৫ দিনের জন্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রংপুরে লংমার্চ শুরু করার আগে অথবা চট্টগ্রামে লংমার্চ শেষ করে দল ঘোষণা হতে পারে।
এদিকে ছাত্রদের নতুন দলের দিকে নজর সারা দেশের। শুধু সাধারণ মানুষই নন বিএনপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলের নজরও সেই দিকে। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এরইমধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে মাঠে রয়েছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোও সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আসছে রমজানকে ঘিরে সবগুলো নির্বাচনমুখী দলেরই মাঠে থাকার প্রস্তুতি রয়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, মার্চ থেকেই শুরু হবে রাজনীতির ডামাডোল।
জানা গেছে, নতুন রাজনৈতিক দলের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব দলমতের মানুষের মতামত নিয়েই দলের নামধাম ও নীতি ঠিক করা হবে। আর এ লক্ষ্যে এরইমধ্যে ৪০ হাজার সার্ভে ফরম পাঠানো হয়েছে সব জায়গায়। আর অনলাইন সার্ভেও চলছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন কৃষক, শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘুসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়া হবে এই সার্ভেতে। জুলাই আন্দোলনের ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নাগরিক কমিটির সদস্যরা গত দুই মাস ধরেই নতুন দল গঠনের রূপরেখা নিয়ে সারা দেশে চষে বেড়াচ্ছেন। এরমধ্যে তিনশ’র মতো উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের হাতে চলে আসবে রিপোর্ট। সেই রিপোর্ট থেকেই বাকি নাম, প্রতীক ও নীতির বিষয় চূড়ান্ত করা হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত সময়ে রাজনৈতিক সরকার ও তাদের দলগুলোর মধ্যে যে বিভাজনের রাজনীতি, কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব দেখা গেছে নতুন দল তা থেকে বেরিয়ে আসবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ও বিভাজনবিরোধী রাজনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই থাকবে দলের প্রধান লক্ষ্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, নতুন দলটি রমজানে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারা দেশে এক ধরনের জনসংযোগ তৈরি করবে। কমিটিতে নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রাধান্য থাকবে। নাগরিক কমিটিতে বয়সের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেটি রাজনৈতিক দলে থাকবে না। কারণ নাগরিক কমিটিতে বয়সের সীমা টানা রয়েছে ৪৫ বছরের মধ্যে।
নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে, বেশিরভাগ সদস্যই আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলামকে চান। উপজেলা কমিটিগুলোর কাছ থেকে এই নামটিই জোরালোভাবে আসছে। সেক্ষেত্রে নাহিদ ইসলামের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার সম্ভাবনা রয়েছে। নাহিদের পরিবর্তে সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে নাগরিক কমিটি থেকে আলী আহসান জুনায়েদ কিংবা আখতার হোসেন উপদেষ্টা পদে যোগ দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য সদস্য সচিব পদে আলোচনায় আছেন নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম এবং যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ। আরও রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন, যুগ্ম সদস্য সচিব মাহবুব আলম ও অনিক রায়ের নাম।
জানা গেছে, প্রথমে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হবে এবং ঈদের পর কাউন্সিলের মাধ্যমে দলীয় কাঠামো ঠিক করা হবে। আহ্বায়ক কমিটির পর নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হবে।
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ দল নতুন দল সম্পর্কে দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ মাসেই দল ঘোষণা হবে। আর লং মার্চ কর্মসূচি আমরা পালন করব। তবে তার তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। রমজান মাস জুড়ে আমাদের কর্মসূচি থাকবে। এরমধ্যে তিনশ’র বেশি থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই দলটি জনগণের দল হবে।
নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান তুহিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের এই দলটা হবে মধ্যপন্থার। না ডান না বাম। এখানে বাংলাদেশকে যারা ভালোবাসে কোনো বিভাজনের রাজনীতির এখানে সুযোগ নেই। রাজনীতির প্রতি দেশের প্রতি যাদের প্রজ্ঞা ও প্রত্যয় থাকবে তারাই এখানে নেতৃত্বে আসবেন। এই দলটা হবে সম্পূর্ণ বাংলাদেশপন্থি। এখানে ফ্যাসিবাদীদের কোনো সুযোগ থাকবে না। আগে যেমন কালোটাকা ও পেশিশক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো সেটা এখানে থাকবে না।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা শুরু হয় তার দুই মাস পর। ৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র পুনর্গঠন, ফ্যাসিবাদীব্যবস্থার বিলোপ ও ‘নতুন বাংলাদেশের’ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সফল করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করে।