Image description
 

ঢাকার মহাখালীর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার জন্য পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন কথিত ‘৩ বড় মুঘল’।

তারা হলেন, মহাখালীর ভুঁইয়াবাড়ির শফিউল্লাহ ভুঁইয়া শফি ‍ওরফে বেলজিয়াম শফি, গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের তিতুমীর কলেজ শাখার সভাপতি রিপন মিয়া ও তার সিন্ডিকেট। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে এই তিনটি চক্র পেছন থেকে নানা ইন্ধন যোগাচ্ছেন। বেলজিয়ামের অবৈধ হুন্ডির টাকা দিয়ে বহিরাগত যুবকদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

চক্রটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্থ দেওয়া ছাড়াও তাদের দুপুরের খাবার ও পানি দিচ্ছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে ভালো হোস্টেলে রাখার প্রলোভন দিচ্ছে।

দাবি আদায়ের নামে চক্রটি ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র মহাখালী, গুলশান, বনানী এলাকাকে অচল করে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে মাঠের রাজনীতিতে ফেরানোর চক্রান্ত করছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্ট দিচ্ছেন। সেই পোস্টে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার ছবি তারা ব্যবহার করছেন। পোস্টে তারা লিখেছেন, ‘তিতুমীর থেকে ফেরা শুরু।’ কেউ লিখেছেন, ‘রাজপথে আমরা আবার।’

কয়েক দিনের আন্দোলনের কারণে ওই এলাকার লোকজন বড় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। সোমবারের রেলপথ অবরোধের কারণে ঢাকার কমলাপুর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়ে যেতে পারেনি। আবার ঢাকায় কোনো ট্রেন ঢুকতে পারেনি। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ট্রেনের যাত্রীরা। এ ছাড়া মহাখালী ও গুলশান একটি বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ার কারণে ওই অঞ্চলের ব্যবসা ও বাণিজ্য ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, তারা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায় করার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে তৃতীয়পক্ষ ঢুকে গেলে এর দায়িত্ব তারা নেবেন না। তবে কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, যদি কেউ বহিরাগত থেকে থাকে তাহলে তাকে চিহ্নিত করার জন্য কাজ করছেন তারা। পাশাপাশি আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড ঝুলানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশের গুলশান অঞ্চলের উপ-পুলিশ কমিশনার তারেক মাহমুদ আমার দেশকে বলেন, ‘তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে পুলিশ সতর্ক আছে। আন্দোলনের নামে যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয় সেদিকে সতর্ক রয়েছে পুলিশ।’

যোগাযোগ করা হলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম গতকাল সন্ধ্যায় আমার দেশকে বলেন, ‘যারা অরাজকতা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে।’

গতকাল মঙ্গলবার মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলন নিয়ে তারা বেকায়দায় আছেন। সড়ক বন্ধ থাকছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানির শিকারের আতঙ্কে রয়েছেন।

এলাকাবাসী জানান, মহাখালী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ভূঁইয়া পরিবারের রাজত্ব চলছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলকে সহযোগিতা করেছে তারা। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের এলাকায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে স্থানীয় নেতারা তাদের কাছে টাকার জন্য ধরনা দেন। বেলজিয়ামের থেকে আসা হুন্ডির টাকা দিয়ে তারা নেতাদের কব্জা করেন। এতে করে তাদের বিরুদ্ধে কেউ ‘টুঁ’ শব্দটিও করতে পারেন না।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই ভুঁইয়া পরিবার নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাদের দিয়ে তিতুমীর কলেজের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে কাজ করছে। গতকাল সকালে মহাখালীর জিপিও ১৪৩ নম্বর ভূঁইয়াবাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির গেট বন্ধ। নিচে একটি মুদি দোকান রয়েছে। বাড়িটিতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। এর আশপাশের লোকজন ছাড়াও বিভিন্ন দোকানের মালিক ওই বাড়িটি চেনেন। সবাই নাম শুনেই সেই বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।

সুমন নামে স্থানীয় এক দোকানি জানান, এই এলাকার প্রভাবশালী ভুঁইয়া পরিবার। সবাই তাদের সমীহ করে চলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার আরও এক বাসিন্দা জানান, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের ক্ষমতা ব্যবহার করেন শফিউল্লাহ ভুঁইয়া। তবে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা খুব বেশি প্রভাবশালী ছিলেন। আন্দোলনরত ছাত্রদের তিনি টাকা দিচ্ছেন। এই প্রতিবেদক ওই বাড়ির গেটে কয়েক জনকে ডাকাডাকি করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিতুমীর কলেজকে অস্থিতিশীল করতে গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিনের হাত রয়েছে। মহাখালী এলাকায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। এতে করে ওই এলাকায় তার বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া স্থানীয় ফুটপাত ও মহাখালীর কাঁচাবাজার থেকে তার নামে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। তিনি ২০১৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ঢাকা-১৭ আসনের মনোনায়ন চেয়েও পাননি। পুলিশ জানিয়েছে, টাকা ঢেলে বহিরাগত যুবকদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করছেন জসিম।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তারা হলেন, তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি রিপন মিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন, সহ-সভাপতি সাকিবুল হাসান, দপ্তর সম্পাদক আনিস মাহমুদ জনি এবং নাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক ইমরান হোসেন পলাশ। চক্রটি ফেসবুকে গ্রুপ খুলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইন্ধন দিচ্ছে। অথচ মহাজোট সরকারের আমলে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় রিপনের নেতৃত্বে হামলার অভিযোগ আছে।

গতকাল দুপুরে তিতুমীর কলেজের গেটের সামনে কথা হয় নিরাপত্তারক্ষী মাহফুজ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করেছে। আইডি কার্ড ছাড়া কাউকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।