
গায়ে ছেঁড়া জামা, ময়লা প্যান্ট, উসকো-খুসকো চুল, ময়লা-কাদাযুক্ত শরীর, চোখে ঘুম ঘুম ভাব- এমনি বেশভূষায় রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ঘুরছে বেশ কয়েকজন পথশিশু। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, তারা ড্যান্ডি নামক মাদকের মরণনেশায় আসক্ত।
নিউমার্কেট এলাকায় প্লাস্টিকের বোতল-কাগজ কুড়ায় করিম (১০)। এই কাজে তার প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয়। তবে আয়ের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করে এই ড্যান্ডির পেছনে। তার সঙ্গে ছিল জাকির (৮) রায়হান (১১)। ওদের প্রত্যেকেই কাজ করে যে টাকা পায়, পুরোটাই উড়ে যায় এ নেশার পেছনে।
কমলাপুর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘদিন ধরে থাকছে ১৫ বছর বয়সি কিশোর আলম। কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিক, লোহা কিংবা পুরোনো জিনিস বিক্রি করে পেট চালায় সে। সারাদিনের ভাঙারি বিক্রির আয় দিয়ে একবেলা খাবার কিনে খায়, আর বাকি দুই বেলা নেশা করে সে।
রাজধানীর নটর ডেম কলেজ রাস্তা, কমলাপুর স্টেশনের সামনের রাস্তা, ব্রিজের ওপর, আট নম্বর প্ল্যাটফরম, ছয় নম্বর বাস কাউন্টার সংলগ্ন ফুটপাত এবং খালি জায়গায় প্রতিদিন প্রায় একশ’ থেকে দেড়শ’ পথশিশু ড্যান্ডি খেয়ে বসে বসে ঝিমায়।
পলিথিনে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে মগ্ন থাকা এক শিশু অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর নাম বলে সোহেল। কেন এই ড্যান্ডি নিচ্ছ, জানতে চাইলে শিশুটি হেসে ওঠে। মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, ‘মোর বাপ-মা নাই, এইল্লাগাইতো ড্যান্ডি খাই’
সালমার বয়স ১১ বছর। জুতোর আঠা (গাম) মেশাচ্ছিল সে। পরে পলিথিনে ফুঁ দিল মেয়েটি। নেশা করার কারণ জানতে চাইলে, সালমার তড়িঘড়ি উত্তর ‘জীবনে সবই খেয়ে দেখেছি। প্রথমে বিড়ি খাইছি, এরপর গাঁজা। এখন পলিথিন টানি।
অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা জানায়, তারা সবাই বন্ধু। একসঙ্গে কাজ করে। প্রত্যেকের চোখে ঘুম আর ক্লান্তির ভাব। জানাল এই ড্যান্ডি খেলে ঘুম ঘুম লাগে। আকাশে উড়ে বেড়াতে মন চায়।
রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, গুলিস্তান, খিলগাঁও, কমলাপুর, মালিবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা এলাকা সরেজমিন ঘুরে শিশু করিম, জাকির, রায়হান, আলম, সোহেল হাবিব, রিমন, সালমার মতো হাজারো শিশুর দেখা মেলে শহরের অলিগলিতে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে ড্যান্ডি সেবন করে এসব শিশু-কিশোর। যত্রতত্র নেশা করতে দেখা যায় ওদের। কেউ একা, আবার কেউ কেউ গোল হয়ে বসে সংঘবদ্ধ হয়ে নেশা করে। কিছুক্ষণ পর পর ঘ্রাণ নিয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে যায় এসব শিশু-কিশোর।
ড্যান্ডি নামক নেশাটি সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় ছিন্নমূল শিশুদের মাঝে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে এর প্রকোপ। কোনো নীতিমালা না থাকায় হাতের নাগালেই মিলছে এ নেশার দ্রব্য। এমনকি এ নেশা থেকে পথশিশু-কিশোরদের রক্ষায় দেখা যায়নি প্রশাসনের জোরাল কোনো ভুমিকাও।
নেশার এই উপকরণটির নাম ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট আঠা, তবে ‘ড্যান্ডি’ নামেই বেশি পরিচিত । ড্যান্ডি এক ধরনের গাম। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপে। তবে এটি জুতা তৈরির প্রধান উপকরণ।
গুলিস্তানে বেশ কয়েকজন মাদকাসক্ত পথশিশুর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, নেশা করার জন্য আঠাটি তারা কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মুচির কাছ থেকে কিনে নেয়। বেশ কয়েকজন মুচির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আঠাটি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয়।
এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন হার্ডওয়্যারের দোকানি জানায়, ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামের আঠাটি ভারত থেকে আসে।
কৌটায় এবং টিউবে দুভাবেই বিক্রি করা হয় আঠাটি। টিউবের আঠাটির দাম ৪০-৫০ টাকা। তবে কৌটায় পরিমাণে বেশি থাকায় দামও বেশি হয়।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, শুধু পথশিশুরাই নয়, ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হচ্ছে সাধারণ পরিবার ও শ্রমজীবী শিশু-কিশোররা। এরাই এক সময় ঝুঁকছে গাঁজা, মদ, ফেন্সিডিল ও ইয়াবার দিকে। আর নেশার টাকার যোগাড় করতে এক সময় তারা জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো নানা অপরাধে।
পথশিশুদের ভালো জীবন দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে থেকে গড়ে ওঠা ‘অদম্য বাংলাদেশ’-এর আরিয়ান আরিফ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি এ শিশুদের মাদকাসক্ত হওয়া থেকে বিরত করতে। পুলিশ যদি একটু আন্তরিক হয় তাহলে এটা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।’
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদকাসক্ত। সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে। এসব জায়গায় ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশু মাদক সেবন করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক গবেষণা ও ইউনিসেফের বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী, ঢাকাতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার।
অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, মাদকাসক্তদের জন্য দেশে সর্বমোট ৩৬২টি নিরাময় কেন্দ্র আছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা চারটি। বেসরকারি কেন্দ্রে ৪ হাজার ৮৪৬টি শয্যা থাকলেও সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা মাত্র ১৭৯টি; যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মূলত ছিন্নমূল শিশু এবং বিভিন্ন কল-কারখানার শিশুরাই এ নেশার প্রতি বেশি আসক্ত। এজন্য তাদের কাউন্সিলিং করা দরকার। যেসব শিশুর বাবা-মা রয়েছে তারা তাদের সন্তান কী করে কোথায় যায়, কী খায় সেদিকে নজর রাখবে। পাশাপাশি এ নেশা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রথমত যারা শিশুদের কাছে ড্যান্ডি গাম বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।