
নাগরিক সেবা সহজ করতে ‘সবার ঢাকা’ নামে একটি মুঠোফোন অ্যাপ তৈরি করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই অ্যাপের নিয়ন্ত্রণই পাচ্ছে না ডিএনসিসি। অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ চেয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিলেও সাড়া মেলেনি। বিপাকে পড়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুরে একটি নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটির বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ডিএনসিসির সবার ঢাকা অ্যাপ আছে। কিন্তু এই অ্যাপের পাসওয়ার্ড আমাদের দিচ্ছে না। আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, এই অ্যাপ তৈরিতে তাঁরা চার কোটি টাকা খরচ করেছেন। পাসওয়ার্ড না দিলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।’
‘সবার ঢাকা’ অ্যাপটি তৈরিতে এই বিপুল পরিমাণ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অ্যাপ তৈরিতে গড়ে ১২ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। অথচ এর ৩০ গুণের বেশি অর্থাৎ ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা ওই অ্যাপ তৈরিতে ব্যয় হয়েছে। এরপরও অ্যাপটির নিয়ন্ত্রণ করপোরেশনের কাছে নেই।
ডিএনসিসির সবার ঢাকা অ্যাপ আছে। কিন্তু এই অ্যাপের পাসওয়ার্ড আমাদের দিচ্ছে না। আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, এই অ্যাপ তৈরিতে তাঁরা চার কোটি টাকা খরচ করেছেন। পাসওয়ার্ড না দিলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।ঢাকা উত্তর সিটির বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ
অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ না-পাওয়া নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, সবার ঢাকা অ্যাপ তৈরিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানির (আইআইএফসি) সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু আইআইএফসি ওয়ালেট মিক্স লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজটি করিয়েছে। বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠান এখনো অ্যাপটির নিয়ন্ত্রণ করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেনি।
সবার ঢাকা অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ ডিএনসিসির কাছে হস্তান্তর করতে গত ২৪ এপ্রিল আইআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। ডিএনসিসির আইসিটি বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্টের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আশরাফুল আলমের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়, অ্যাপ তৈরি প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কারিগরি বিষয়াদিসহ সার্বিকভাবে অ্যাপটি বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হলেও তা করা হয়নি। তাই জরুরি ভিত্তিতে অ্যাপের যাবতীয় বিষয় ২৭ এপ্রিলের মধ্যে বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে অ্যাপ তৈরির কাজ আইআইএফসিকে দেওয়া হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়ালেট মিক্সকে কাজ দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের ভাগনে তৌফিক জায়েদুর রহমান। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও ওয়ালেট মিক্সের কাছ থেকে ওই অ্যাপ বুঝে নিতে তখন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। এখন আওয়ামী লীগের পতনের পর ওয়ালেট মিক্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আর কোনো খোঁজ নেই।
সফটওয়্যার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল চুক্তি অনুযায়ী অ্যাপটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা। সেটা না করে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। এখন সফটওয়্যারটি বুঝে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটি অ্যাপ হস্তান্তর করছে না।সিস্টেম এনালিস্ট আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আশরাফুল আলম
ডিএনসিসির আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সবার ঢাকা অ্যাপটি তৈরিতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ২০২০ সালের অক্টোবরে আইআইএফসির সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে আইআইএফসি ওই অ্যাপ তৈরির জন্য ওয়ালেট মিক্সের সঙ্গে চুক্তি করে। মূলত এসব ছিল লোক দেখানো চুক্তি। কারণ, আইআইএফসির সঙ্গে ওয়ালেট মিক্সের চুক্তি হয় ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর। অথচ এর ৯ মাস আগেই ওই বছরের ১০ জানুয়ারি সবার ঢাকা অ্যাপের উদ্বোধন করা হয়। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত উদ্বোধনী ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, আসলে আইআইএফসিকে চিঠি দিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ, কাজটি মূলত ওয়ালেট মিক্সের মাধ্যমে করানো হয়েছিল। এখন ওয়ালেট মিক্সকে দরকার। কিন্তু খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ-২ নম্বরে ওই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় বা কর্মকর্তাদের কাউকে পাওয়ায় যাচ্ছে না। তাদের বর্তমান কার্যালয় কোথায়, সেটিও জানেন না সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে সিস্টেম এনালিস্ট আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সফটওয়্যার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল চুক্তি অনুযায়ী অ্যাপটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা। সেটা না করে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। এখন সফটওয়্যারটি বুঝে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটি অ্যাপ হস্তান্তর করছে না। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তবে ওয়ালেট মিক্সের বাণিজ্যিক ছাড়পত্র (ট্রেড লাইসেন্স) বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পটপরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসন ওই অ্যাপ এখন বুঝে নিতে চাইছে। ওয়ালেট মিক্স এ নিয়ে গড়িমসি করছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশনের চিঠি পেয়ে অ্যাপের যাবতীয় কারিগরি বিষয় গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল করপোরেশনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।আইআইএফসির অতিরিক্ত পরিচালক মুন্সি শহীদ আনিস
এদিকে আইআইএফসির অতিরিক্ত পরিচালক মুন্সি শহীদ আনিস ৩ মে প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি শেষের পর ২০২৩ সালে ওই অ্যাপ সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষের ওই অ্যাপ পরিচালনার জনবল না থাকায় আইআইএফসির সঙ্গে চুক্তিতে অ্যাপ প্রস্তুতকারী ওয়ালেট মিক্সের কাছে সহযোগিতা নেয়। এত দিন ওই প্রতিষ্ঠানই অ্যাপ পরিচালনায় করপোরেশনকে সহযোগিতা করে আসছিল।
মুন্সি শহীদ আনিস আরও বলেন, পটপরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসন ওই অ্যাপ এখন বুঝে নিতে চাইছে। ওয়ালেট মিক্স এ নিয়ে গড়িমসি করছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশনের চিঠি পেয়ে অ্যাপের যাবতীয় কারিগরি বিষয় গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল করপোরেশনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ বুঝে পায়নি ডিএনসিসি।
ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, অ্যাপের মাধ্যমে যে ধরনের তথ্য গ্রহণ ও প্রদান করা হয়, এতে অ্যাপ মেইনটেন্যান্স ও সার্ভার বাবদ প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা হিসাবে এক বছরে এ বাবদ ব্যয় হতে পারে ১৮ লাখ টাকা।
অ্যাপ তৈরির অস্বাভাবিক ব্যয়
‘সবার ঢাকা’ অ্যাপ তৈরি প্রকল্পে ঢাকা উত্তর সিটির ব্যয় হয়েছে মোট ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। চুক্তির মধ্যে অ্যাপ তৈরি (ডেভেলপমেন্ট), এক বছর রক্ষণাবেক্ষণ (মেইনটেন্যান্স) ও সার্ভারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন পর্যন্ত গুগল প্লে-স্টোর থেকে সবার ঢাকা অ্যাপটি প্রায় ৫১ হাজার ডাউনলোড হয়েছে। তবে এর সক্রিয় ব্যবহারকারী বর্তমানে কতজন, সেই তথ্য করপোরেশনের আইসিটি বিভাগের কাছে নেই।
সবার ঢাকা অ্যাপের ধরন ও কারিগরি দিক বিশ্লেষণে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সফটওয়্যার তৈরির তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা সবার ঢাকা অ্যাপ তৈরিতে এই বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় হওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁদের কাছ থেকে ওই অ্যাপ তৈরিতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যয়ের যে ধারণা পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী সবার ঢাকা অ্যাপ তৈরিতে ৩০ গুণের বেশি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এই অ্যাপ তৈরিতে খরচ হতে পারে প্রায় ১০ লাখ টাকা।টেক জেনিথের স্বত্বাধিকারী মিয়াদ হোসেন
যাচাইকারী ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান নাম প্রকাশ করতে চায়নি। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান হলো নিবসিস লিমিটেড ও টেক জেনিথ।
নিবসিস লিমিটেডের লিড অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী শেখ ফয়সাল হোসেন বলেন, অ্যাপটি তৈরিতে দুই থেকে তিনজন ডেভেলপারের সর্বোচ্চ তিন মাস সময় লাগতে পারে। তাঁদের পারিশ্রমিকসহ অ্যাপটি তৈরিতে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো লাগতে পারে। অ্যাপের মধ্যে বড় পর্যায়ের কোনো কাজ নেই।
টেক জেনিথের স্বত্বাধিকারী মিয়াদ হোসেন বলেন, ‘এই অ্যাপ তৈরিতে খরচ হতে পারে প্রায় ১০ লাখ টাকা।’
আর নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ধারণা, এই অ্যাপ তৈরিতে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। সরকারি কাজের হিসাবে একাধিক হাতবদলের হিসাব করে তাঁরা এমন ধারণা দিয়েছেন।
এ তিন প্রতিষ্ঠানের গড় করলে ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ টাকা। এর প্রায় ৩০ গুণের বেশি অর্থাৎ ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা ওই অ্যাপ তৈরিতে ব্যয় হয়েছে। ওই ব্যয়ের সঙ্গে অ্যাপটির মেইনটেন্যান্স ও সার্ভারের ব্যয়ও যুক্ত হবে। ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, অ্যাপের মাধ্যমে যে ধরনের তথ্য গ্রহণ ও প্রদান করা হয়, এতে অ্যাপ মেইনটেন্যান্স ও সার্ভার বাবদ প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা হিসাবে এক বছরে এ বাবদ ব্যয় হতে পারে ১৮ লাখ টাকা।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওয়ালেট মিক্সের মালিক হুমায়ূন কবিরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে করপোরেশনের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।