
Maskwaith Ahsan (মাস্কওয়াইথ আহসান)
জাতীয় নাগরিক কমিটি তার দল গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণ-তরুণীদের তাদের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। ছাত্রদল ও বাম ছাত্রসংগঠন সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একটি সংগঠনের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানালে; বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে।
ছাত্রদল ঐ সম্মেলনে যায়নি; কারণ ৫ অগাস্টের পর তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখার প্রতীক্ষায় অশান্ত। বাম ছাত্র সংগঠনের ছেলেমেয়েরা যায়নি; কারণ আমাদের দেশের বাম ছেলেমেয়েরা বড্ড অহংকারি হয়। বঙ্গভঙ্গ বিষয়ক জটিলতায় জমিদারের ছেলেরা প্রথম অনুভব করেছিলো; বৃটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা দরকার, এবার চলো বাম হই। সেই বামের অস্থিধারণ করে আজকের বাম জমিদারের ছেলে না হলেও ভাবভঙ্গি তাদের জমিদারের। আর আন্দোলনের কয়েকদিন দাড়ি টুপি হিজাবের মানুষ মেনে নিলেও; যেহেতু ছাত্রশিবিরের ছেলে-মেয়েরা ঐ সম্মেলনের আমন্ত্রণ রক্ষা করেছে; সেখানে গরিবের ফ্রিডরিশে নিটশে বামেরা আর যাবে কি করে!
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু এনসিপির আমন্ত্রণে মিনিমাম কার্টেসিটুকু দেখায়; এনসিপিও তা রেসিপ্রোকেট করতে তাদের সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠায়। প্রতিনিধি পাঠানোর অর্থ এই নয় যে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সম্মেলনে যে বক্তব্য রাখে তাতে একমত এনসিপি। এই কমনসেন্স টুকু কারো কারো নেই। আর কেউ কেউ ৫ অগাস্টের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছেলেমেয়েদের ছিদ্রান্বেষণ করছেন। কেন করছেন কোন ভঙ্গিতে করছেন তার অনুবাদ নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ করতে পারেন।
আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ায়; বিএনপি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল। ফলে যে একটিভিস্টরা ইউটিউবে হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় থেকেছেন; তাদের বড় একটি অংশ বিএনপির কাছ থেকে পদ-পদবী-পদক পেতে ৫ অগাস্টের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের খুঁত খুঁজে বের করছেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশকে আস্তে করে প্রগতিশীল মন্দিরে নিয়ে গিয়ে ব্যাপ্টিজম করেছেন; আওয়ামী প্রগতিশীল চলে যাওয়ার পর শূণ্যপদে নতুন প্রগতিশীল খালা ও মামারা। এরা ছোট্ট একটু ঢাকা শহরে খেলনা এলিট সেজে ঘুরছেন আর নানা লাস্যে এনসিপিকে মৌলবাদি তকমা দেয়াচ্ছেন নতুন ব্যাপ্টিজম পাওয়া বৈষম্য শিশু দিয়ে।
বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ম এটাই। এখানে সিজনড লিবেরেল বদরুদ্দীন উমর, আহমদ ছফা, শফিক রেহমান, ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খানকে ইসলামপন্থীর তকমা দিয়েছে খেলনা প্রগতিশীলেরা। হিন্দুত্ববাদীদের একটি অংশ কামার-কুমার-তাঁতী-জেলের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দিয়ে একালের বংকিমচন্দ্র সেজে নির্ধারণ করে বেড়ায় কে প্রগতিশীল ও কে রক্ষণশীল। আর আছে ঢাকা-টু-কলকাতা সাংস্কৃতিক দৌড়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কেরানির বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছেলেমেয়ে; যারা জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির মতো কস্টিউম পরে গাল ফুলানো প্রগতিশীল হয়ে একে ওকে ছাগু ডেকে বেড়ায়। সামাজিক গতিশীলতা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হবার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও প্রণয় নিকেতনের মাসহরায় এক পুরুষে দলান্ধ সুশীল সাজার প্রবণতাটিই সামাজিক বিশৃংখলা ও কালচাঁড়াল ডিবেটের প্রধান কারণ।
ফার্স্ট জেনারেশন প্রোগেসিভ সিলেক্টিভ ট্রুথে বিশ্বাসী। সে বিএনপি আমলে নির্যাতিত পূর্ণিমা শীলকে নিয়ে কাঁদে; কিন্তু আওয়ামী আমলে নির্যাতিত সুবর্ণচরের গৃহবধুর ব্যাপারে স্পিকটি নট থাকে। মাছুদা ভাট্টিকে ব্যারিস্টার মইনুল অপমান করেছে বলে প্রেসক্লাব মাতায়; আবার সিপি গ্যাং ফেসবুকে নারীদের চ-বর্গীয় গালি দিয়ে বেড়ালে সেখানে গিয়ে হাহা ইমো দেয়; অথবা প্রণব মুখার্জির মতো মুখ টিপে হাসে।
সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে সিপি গ্যাং-এর নারী নিগ্রহ চুপটি করে দেখে; অধুনা ধর্মের নামে গ্যাং করা লোকেদের নারী নিগ্রহ দেখে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন।
বাংলাদেশে প্রতিটি নারী নিগ্রহের ঘটনায় প্রোগ্রেসিভ আপারা যদি সোচ্চার থাকতেন তাহলে আজ ধর্মের নামে গ্যাং গুলোর সাহস হতো না; সিপি গ্যাং-এর মতো আচরণ করার।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আইকিউ কম বলেই তারা দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষী বক্তব্য প্রচার করে। এখন বুঝতে পারছেন তো; কেন এরা বড় বড় শো ডাউন করার পর মাত্র একটি বা দুটি আসন পায়; প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সাকুল্যে দশ-বারো হাজার ভোট পায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি নারী। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জিডিপির বড় একটি অংশ অর্জনে ভূমিকা রাখে নারী সমাজ। নারীর জন্য শিক্ষা উপ-বৃত্তি চালু করার পর থেকে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। পরীক্ষার ফলাফলে তাদের ঔজ্জ্বল্য চোখে পড়ার মতো। কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রণিধানযোগ্য। নারীর এই দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দেখে শার্ট প্যান্ট পরা সাহেব পুরুষই ঈর্ষান্বিত; সেখানে দাড়ি-টুপিওয়ালার থরোকম্প হবে এতে অবাক হবার কিছু আছে কি।
নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে গ্যাং করা লোকেরা সোচ্চার হলেও প্রগতিশীলতার নামে গ্যাং করা লোকের খুব সাঁই আছে ভাবছেন কেন। এরা ফেসবুকে এসে নারীর অধিকার নিয়ে চুক চুক করে আসলে নারীমহলে হিরো হীরালাল হতে চায়। বোনকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ভাগ দিতে দিতে পাঁড় কমুনিস্টও শরিয়া আইন খুঁজে। আর হিন্দু কমিউনিস্টের কথা নাইবা বলি। দক্ষিণ এশিয়ার জামাই আদর আসলে বোনকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ বঞ্চিত করতে তার স্বামীকে বশ করা। বোনের স্বামীকে সারাজীবন পোলাও খাইয়ে বোনকে এক ছটাক জমিও না দেবার কলাকৈবল্য এগুলো। একারণেই দেখবেন ভূ-সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সবচেয়ে কম। এক্ষেত্রে কিছু নিপাট ভদ্রলোক আছেন যারা স্ত্রীর নামে বাড়ি করেন; কিংবা বোনের সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন; বোনের বিপদে তার একাউন্টে টাকা পাঠান। অথচ এই ভদ্রতাই সামাজিক নিয়ম হবার কথা ছিলো। পৃথিবীতে মা-কন্যা-বোন-স্ত্রীর মতো মায়াময় মানুষ পুরুষের জীবনে আর কেউ তো নয়।
এই যে দাড়ি টুপিওয়ালা লোকগুলো নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়; এই লোকগুলো বুড়ো বয়সে স্ট্রোক করে মুখ বেঁকে গেলে ছেলে তাকে দেখে না। ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে দারাশিকো হয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। এখানে মেয়েকে যদি পড়ালেখা শিখিয়ে চাকরি করতে দেয়া হতো, তাহলে মেয়েটিই অসুস্থ বাপকে দেখতো। এমনকি এম্পটি নেস্টার নিও এলিট যারা; তারাও হুইল চেয়ারে মুখ বাঁকা হয়ে কাত হয়ে ঝুলে থাকলে; ছেলে একদিনের জন্যও একটু বসে গল্প করে না। মেয়ে এসেই বাপের যত্ন নেয়। মেয়ের নাতি-নাতনি নানাকে আনন্দ দেয়। আর ছেলের ঘরের নাতি-নাতনি যেন দাদার বাড়িতে কম আসে সেটা নিশ্চিত করে নিষ্ঠুর ছেলের বউ। আছে নারীদের মাঝেও খলনায়িকা আছে।
শেখ হাসিনা যেমন নারী হয়েও খলনায়িকা। ঘাতকের তো জেন্ডার থাকে না। তাই ঘাতক নেতানিয়াহুর এফিজিকে যেমন প্রতীকী ক্রিমেশন করে এমেরিকার এলিট ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়েরা; বাংলাদেশের ছেলেরাও তেমনি ঘাতক হাসিনার এফিজিকে প্রতীকী ফাঁসি দেয়। বাংলাদেশের নিও লিবেরেল লোকেরা যেহেতু হাসিনা আস্তাকুড় ও এফিজির ফাঁসি দেয়াকে রুচির পতন মনে করে; অগত্যা দু'চারজন দাড়ি টুপিওয়ালাকে দেখা যায় হাসিনার এফিজিতে জুতা মারতে; যেহেতু সাজানো জঙ্গী অভিযানে পনেরো বছর ধরে রাষ্ট্রের কারাগারে নিঃগৃহীত ছিলো ওরা। সেই এফিজিতে দাড়ি টুপিওয়ালাকে জুতা পেটা করতে দেখে ঘুটা দেয় আওয়ামী নারীবাদী ও মোদির মানসপুত্রেরা, ঐ দ্যাকো মোল্লারা নারী বিদ্বেষ প্রকাশ করছে। কেউ কেউ, তাই বলে একজন নারী এমন অপমান বলে ছ্যা ছ্যা করে ওঠে।
ইউরোপে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যারকেল বিকিনি পরা এফিজি নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল দেখেছি, হিলারির স্বল্পবসনা এফিজি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল দেখেছি; আর প্রতিবাদের ভাষা কেমন হওয়া উচিত তা শিখতে হবে ঢাকা গ্রামের ললিতা-আনারকলি-কল্পনা-আল্পনার কাছে! কি বিচিত্র এই চাওয়া।
এইসব ঘষেটি বেগমের চিকন বুদ্ধি দিয়ে নারী আন্দোলন হয় না। অযথা ফ্রিডা কাহালোর পোস্টার টাঙ্গিয়ে কিংবা ভার্জিনিয়া উলফের বই নিয়ে ছবি তুলে লাভ নাই। ভাবতে হবে ধুলোমলিন ৫৬ হাজারের নারীসমাজের মুক্তি নিয়ে। তাদের তো হোয়াইট টেলিফোন ফেমিনিজম দরকার নাই। তাদের দরকার মৌলিক মানবাধিকার পূরণ, চলাফেরার নিরাপত্তা, আইনের রক্ষাকবচ। সারাদিন মিডল এইজ ক্রাইসিসের মাডাম বোভারির মুড সুইং আর আনসেলেটড দাম্পত্য জীবনের হাই এন্ড গল্প শুনে আমাদের লাভ কি!
আমরা চাই দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে আলোর অলক্ষ্যে ঝরে পরা বেগম রোকেয়া, মাদাম কুরি, ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভাদের বিকশিত জীবন। সে ব্যবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রকে করতে হবে। একটা জনপদের সভ্যতার সূচক হচ্ছে, সেখানে নারী ও শিশুরা কতটা নিরাপদ।
(ছবিতে হাসিনার এফিজির প্রতীকী ফাঁসি)