কোটি টাকা ব্যয়ে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যয় নির্ধারণের অভিযোগ সামনে আসায় প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের আমলে নেওয়া হয় এ প্রকল্প।
জানা গেছে, ২০২২ সালে ঢাকার চারটি খাল উদ্ধার ও সংস্কারের জন্য প্রকল্পটি হাতে নেয় ডিএসসিসি। শ্যামপুর, জিরানী, মান্ডা ও কালুনগর খাল উদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয় প্রকল্প প্রস্তাবে। এর আওতায় খালের পাড় ঘিরে ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন, ফুডকোর্ট, শিশুদের খেলার জায়গা, ব্যায়ামাগার নির্মাণ, সবুজায়নসহ সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা ডিএসসিসির।
ঢাকা টাইমসের হাতে আসা প্রকল্প প্রস্তাব থেকে জানা যায়, জিরানী খাল সংস্কার প্রকল্পের আওতায় তার দুই প্রান্তে দুটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করার কথা। এর ব্যয় ধরা হয় দুই কোটি ছয় লাখ টাকা। টয়লেটসহ প্রকল্পের অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ধরা হয়েছে বলে জানান নির্মাণ প্রকৌশলীরা। তারা বলছেন, পলি অপসারণ থেকে শুরু করে সৌন্দর্যবর্ধন সব ক্ষেত্রেই মূল্য বাড়িয়ে ধরা হয়েছে।
এদিকে জিরানী খালের দুই প্রান্তে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও, সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা নেই বলে জানা গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মানচিত্র অনুযায়ী জিরানী খালের শুরু সবুজবাগের কুসুমবাগ ব্রিজের নিচ থেকে, শেষ ত্রিমোহনী বাজার সংলগ্ন বালু নদে। কাগজে-কলমে প্রায় চার কিলোমিটার দীর্র্ঘ এবং ৬৫ ফুট প্রস্থের খালটি কোথাও কোথাও দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে ২০ ফুট প্রস্থে নেমেছে। দখল করে খালের দুই পাশে ঘরবাড়িও নির্মাণ করেছে স্থানীয়দের কেউ কেউ।
প্রকল্প প্রস্তাবে দেখা যায়, জিরানী খাল সংস্কার করে অবকাঠামো নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ১৬৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
অত্যধিক ব্যয় নির্ধারণের অভিযোগ সামনে আসে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এত দিনের বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রকৌশলীরা তখন বিক্ষোভ দেখান। তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানসহ আওয়ামীপন্থিদের অপসারণের দাবি করেন তারা। এ সময় তাপসের আমলে নেওয়া চার খাল উদ্ধার ও সংস্কার প্রকল্পের বিষয়টি সামনে আসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন প্রকৌশলী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশেষ সুবিধা দিতে বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হতো। ঢাকার চার খাল উদ্ধার ও সংস্কার প্রকল্পটি বাস্তবতার আলোকে করা হয়নি। একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ব্যয় কখনো কোটি টাকা হতে পারে না।’
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এরই মধ্যে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) খায়রুল বাকেরকে দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি ঢাকার চার খালের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করেছিলেন। সাবেক মেয়র তাপসপন্থি ঠিকাদারদের অনৈতিক সুবিধা দিতেই অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাবলিক টয়লেট নির্মাণে অস্বাভাবিক ব্যয় নির্ধারণ প্রসঙ্গে খায়রুল বাকের ঢাকাটাইমসকে বলেন, পুরো প্রকল্পে ১০টি টয়লেটের জন্য ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ওপর ভিত্তি করে খরচ কম-বেশি ধরা হয়েছিল। খাল উন্নয়নের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাক্কলন করা হয়ে থাকে। পানি আইন অনুযায়ী খালের দুই পাশে ৩০ ফুট করে মোট ৬০ ফুট খাস জমি উদ্ধার করে সমন্বিত উন্নয়নের পরিকল্পনা ছিল।
দায়িত্ব থেকে তাকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে খায়রুল বাকের বলেন, এটা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। প্রকল্পটিতে এখন নতুন পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, রাষ্ট্রের অর্থ যাতে অপব্যয় না হয়, প্রতিটি অর্থের যাতে সঠিক ব্যবহার হয়, ঢাকার খাল উদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির প্রকল্পটি পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগের চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে বাস্তবতার নিরিখে জলাবদ্ধতা নিরসনে যে যে কাজ করা সম্ভব, সেটি বিবেচনায় নিয়ে মূল্যায়ন করা হবে। বাস্তবতার আলোকে হয়তো বা ব্যয় কমে যেতে পারে।
খাল উদ্ধারের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবৈধ দখলদারদের থেকে খাল উদ্ধার করা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এজন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। একটা জরিপের বিষয় রয়েছে, সে কাজগুলো আমরা করছি। এটা আগেও করা হয়েছিল। তখন (মেয়র তাপসের আমল) একটা দৃষ্টিভঙ্গি ও একটা চিন্তাভাবনা ছিল।’
পরিবর্তিত অবস্থায় বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নিয়ে অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করে সে কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা হবে জানিয়ে মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রকল্প ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পিডিকে (প্রকল্প পরিচালক) সরিয়ে নতুন পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার আলোকে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা হবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা ভেবেই নিই, কিছু দুর্নীতি হবে। এই সুযোগে চার-পাঁচ গুণ বাড়িয়ে ব্যয় নির্ধারণ করে, যেটা অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে আমলাসহ যারাই জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।’