
গুরুতর অসুস্থ হলে জীবন রক্ষায় সবাই দৌড়ান হাসপাতালে। আর হাসপাতাল মানেই মহান চিকিৎসাসেবা ও মানবিকতার প্রতীক। কিন্তু রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ‘ইউনাইটেড হাসপাতাল’ যেন দীর্ঘদিন ধরেই চলছে উল্টোপথে। অভিযোগ রয়েছে, এ হাসপাতালে নানা ফন্দিতে রোগীদের দীর্ঘদিন ভর্তি রেখে মোটা অঙ্কের বিল আদায় করা হয়। যে অপারেশনের হয়তো প্রয়োজনই নেই, সেটিও টাকা কামানোর জন্য কৌশলে রোগীকে বাধ্য করা হয়। নানা ধরনের পরীক্ষা ও সেবার নামেও রোগী-স্বজনদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় বাড়তি ভুতুড়ে বিল। ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এখন অহরহ পাওয়া যায়।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায় রোগী মৃত্যুর মতো বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগও আছে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এমনকি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর লাশ আটকে রেখে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অভিযোগও ওঠে এ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এ ধরনের নানা অভিযোগ থাকলেও তাতে তেমন কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ‘পাঁচতারকা’ মানের হাসপাতাল হওয়ায় সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষও ইউনাইটেড হাসপাতালের অভিযোগ তদন্তে কোনো ভূমিকাই রাখছে না, একেবারে নীরব তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৫ বছর আগে ২০০৮ সালে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক মান্নার মৃত্যুর পর ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে ‘ভুল’ চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছিল। বুকে ব্যথা নিয়ে চিত্রনায়ক মান্না ওই হাসপাতালে ভর্তি হলে কয়েক ঘণ্টা পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মান্নার শ্যালক রেজা কাদের তখন মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় হাসপাতালের ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন।
এদিকে মাত্র দেড় মাস আগে গত ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন নাগরিক গালফ এয়ারলাইন্সের পাইলট ইউসুফ হাসান আলহেন্দি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে তিনি মারা যান। এ ঘটনার পর গত সপ্তাহে ঢাকায় এসে মৃতের বোন তালা ইলহেন্দি জোসেফানো অভিযোগ করেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে যথাসময়ে এবং ঠিকমতো তার ভাইয়ের চিকিৎসা না করায় করুণ মৃত্যু হয়। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় পড়েছে ইউনাইটেড হাসপাতাল।
ইতিমধ্যে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতিও দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তার মাঝেই আবারও ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও অবহেলার বিষয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হকের চিকিৎসাসেবা নিয়ে। দেশের স্বনামধন্য এ ব্যবসায়ীও অসুস্থ হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে মারাত্মক বিড়ম্বনা ও অবহেলার শিকার হয়েছেন।
আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যানের চিকিৎসায় অবহেলাজনিত জিডির তদন্তের বিষয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই হাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেছেন, ‘বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এম এম এনামুল হকের চিকিৎসায় অবহেলা ও দুর্ব্যবহারসহ যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনার সময় হাসপাতালে যারা ডিউটিতে ছিলেন তাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।’
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শামসুদ্দিন হাওলাদার (৯০) নামে একজন প্রবীণ নাগরিক অসুস্থ হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সে সময় তাকে এমআরআই করার জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে স্বজনরা সে পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তখন ইউনাইটেড হাসপাতালে এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকার কথা বলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা রোগীকে পার্শ্ববর্তী জয়নুল হক সিকদার মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে এমআরআই পরীক্ষার পর বিল করা হয় ১৪ হাজার টাকা। কিন্তু সেই বিল কৌশলে নিজেদের হাতে নিয়ে নেন ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্মীরা। অথচ রোগীর ছাড়পত্র দেওয়ার দিনে এমআরআইয়ের সেই ১৪ হাজার টাকার বিলের সঙ্গে আরও ৯ হাজার টাকা বাড়িয়ে রোগীকে ২৩ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয় ইউনাইটেড হাসপাতাল। এ বিষয়ে ওই রোগীর ছেলে মোহসিন আহমেদ প্রতিবাদ করলে তখনকার ডিউটি কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলে লাভ হবে না। এটাই ইউনাইটেড হাসপাতালের এমআরআইয়ের খরচ।’
২০১৬ সালে এ ঘটনায় ইউনাইটেড হাসপাতালে ভুতুড়ে বিল নিয়ে তখন একাধিক গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশ হয়েছিল। এ ছাড়াও ২০২০ সালের ২৭ মে করোনা মহামারির সময় ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর করুণ মৃত্যু হয়। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগে মামলা হলে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান-এমডিসহ শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ। পরে মামলাটি উচ্চ আদালত হয়ে আপিল বিভাগে গেলে আদালতের নির্দেশে নিহত চারজনের পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা করে দিতে হয় হাসপাতালটিকে। আর মনিরুজ্জামান নামে মৃত অপরজনের পরিবারের সঙ্গে আদালতের বাইরেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সুরাহা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের ১৬ আগস্ট গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসা খরচের টাকা না দেওয়ায় এক ব্যক্তির লাশ আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডের বাসিন্দা মো. আসলাম হোসেন (৫৪) প্রায় দেড় মাস ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান। তার চিকিৎসা খরচ বাবদ ৩১ লাখ টাকার মধ্যে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তার পরিবারের সদস্যরা। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তর করছে না বলে অভিযোগ করেছিলেন আসলামের মেয়ে সাদিয়া ইসলাম। বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে কথা হয় ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ শাখার ব্যবস্থাপক আরিফুল হকের সঙ্গে। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনাই আলাদা। একটির সঙ্গে আরেকটিকে মেলানো উচিত নয়। পাইলটের মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের (ইউনাইটেড হাসপাতালের) অবস্থান পরিষ্কার করে বিবৃতি দিয়েছি। এখানে কোনো ধরনের অবেহলা ছিল না। আর মৃত্যুর দেড় মাস পরে এসে বিদেশি কেউ বোন বা স্বজন দাবি করে ডকুমেন্ট চাইলেও তাকে শনাক্ত না করা পর্যন্ত সেসব তথ্য দেওয়া যায় না। এ ছাড়া অতিসম্প্রতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যানের চিকিৎসাসেবা নিয়ে যা হয়েছে সেগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখছে। এ বিষয়ে এখন কোনো বক্তব্য আমরা দিচ্ছি না। সময়মতো এ বিষয়ে বিবৃতি দেওয়া হবে।’