Image description

জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ছিলেন। জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী বলেছেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

৪৪ বছর আগের জিয়া হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এ কথা বলেন জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। তিনি সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অনেক কিছু এখনো অজানা। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ নিয়ে নানা ধরনের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেই লাশের বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা আমার দেশকে শুনিয়েছেন তৎকালীন ডিসি।

জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীর কাছে আমার দেশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়—প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশের কী হয়েছিল? দাফন কীভাবে হয়েছিল

প্রশ্নোত্তরে জিয়াউদ্দিন বলেন—সেদিন (১৯৮১ সালের ৩০ মে) ভোরবেলায় সার্কিট হাউসে গিয়ে সবকিছু দেখে এসে খোঁজ করছিলাম প্রেসিডেন্টের লাশ কোথায় কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে। হঠাৎ জানতে পারলাম লাশ সার্কিট হাউস থেকে সেনারা নিয়ে গেছে। তবে লাশ সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়নি। রাঙ্গুনিয়া থানার পুলিশ থেকে জানা গেল, রাতের বেলায় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য একটি মিলিটারি ট্রাকে করে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃতদেহ রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানির কাছে একটি খালি জায়গায় নিয়ে যায় এবং একজন মৌলবি অস্ত্রের মুখে ভয়ে লাশ কার না জেনেই জানাজা ও দাফনের কাজে সাহায্য করেন। পরে স্থানীয় জনগণের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার মারুফ থানা অফিসারকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ট্রাকে করে চট্টগ্রাম নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। আমি শুনে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, প্রেসিডেন্টের লাশ চট্টগ্রাম শহরের কোথাও আনা ঠিক হবে না। সোজাসুজি নিয়ে যেতে হবে সেনানিবাসে। জানালাম, আমি ও পুলিশ সুপার রাঙ্গুনিয়ায় গিয়ে লাশ নিয়ে সেনানিবাসে যাব। এই পরিকল্পনা পুলিশ সুপার রাঙ্গুনিয়া পুলিশকে জানালেন। আমি, পুলিশ সুপার এবং বিভাগীয় কমিশনার রাঙ্গুনিয়া গেলাম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই দেখি রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশ ট্রাকে করে প্রেসিডেন্টের লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়েছে। গাড়ি থামিয়ে তাদের আমাদের সঙ্গে সেনানিবাসে যেতে বললাম।

প্রথমে লাশ সেনানিবাসে নিতে হবে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজকে প্রেসিডেন্টের লাশের খবর জানাই। ঢাকায় খবর দিয়ে তিনি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেন। লাশ আসার পর সেনানিবাসে আমরা দু-তিন ঘণ্টা ছিলাম। লাশ মর্গে নিয়ে ড্রেসিং সমাপ্ত করা হলো। সেনানিবাসের তৎকালীন সহকারী প্রধান সামরিক ডাক্তার লে. কর্নেল তোফায়েল ড্রেসিংয়ের পর লাশ দেখতে আমাদের ডাকলেন। দেখলাম মৃতদেহ আগাগোড়া ব্যান্ডেজে বাঁধা, তবে মুখ খোলা। একটি গালে কোনো মাংস নেই। গোঁফের একটি অংশও নেই। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

 

লাশ হেলিকপ্টারে তোলা হবে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আজিজ জানালেন, সেনাসদস্যরা জিয়ার জানাজা ছাড়া মৃতদেহ ঢাকায় পাঠাতে দেবেন না। লোকজন ইতোমধ্যে জেনে গেছেন। দেরি করলে তারা ভিড় করবেন, সমস্যা হতে পারে। আমি বললাম, মৃতদেহ হেলিকপ্টারে তোলার পর লাশবাহী হেলিকপ্টার সামনে রেখে সেখানে জানাজা হতে পারে। হেলিপ্যাডে জানাজার ব্যবস্থা হলো। কফিন হেলিকপ্টারে তোলা হলো। ক্যান্টনমেন্টের শ-তিনেক সৈন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি ও সাইফুদ্দিন একপাশে দাঁড়ালাম। গ্যারিসনের একজন মাওলানা জানাজা পড়ালেন।
তারপর হেলিকপ্টার ঢাকার দিকে উড়াল দিল। পরে বিকালে চট্টগ্রামে গায়েবানা জানাজা হলো লালদীঘি ময়দানে। সেখানে গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। লাখ লাখ লোকের জমায়েত। লোক আসছেই। জিয়ার গায়েবানা জানাজা পড়া হলো।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার আগে আপনার সঙ্গে কখন দেখা হয়? কী কথা হয়েছিল? আগের দিন চট্টগ্রামে উপস্থিত হয়ে তিনি কী করেছিলেন?

জিয়াউদ্দিন : হত্যাকাণ্ডের আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয় রাত ৯টার কিছু সময় পর্যন্ত সার্কিট হাউসে। আমি ও বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন সার্কিট হাউসে উপস্থিত ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সঙ্গে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দলীয় কোন্দল মেটানোর বৈঠকটি শেষ হচ্ছিল না। ওই বৈঠক শুরু হয়েছিল ২৯ মে দুপুরের খাবারের পর থেকে। বৈঠকটি এতই দীর্ঘ হয় যে, গেলন গেলন চা পরিবেশিত হয়েছিল। রাত ৯টার বেশ কিছু সময় পর প্রেসিডেন্টের একান্ত সচিব লে. কর্নেল মাহফুজকে আমরা কতক্ষণ থাকব সাইফুদ্দিন সাহেব জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানান, প্রেসিডেন্ট আমাদের চলে যেতে বলেছেন। সকালে আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। মিটিং তখনো চলছিল। তারপর আমরা চলে যাই। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত ছিল। সেখানে চলে যাই স্ত্রী নিয়ে। বেশ রাতে বাসায় ফিরি, ১টার মতো হবে। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে হবে।

প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৮১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি কক্সবাজারে আসেন এক সেনা মহড়া দেখতে। এ মাসে তিনি যে আবার চট্টগ্রাম সফরে আসবেন, কেউই সে সময় আমাকে কিছুই জানাননি। ফলে মাত্র দুই সপ্তাহ পর তার আবার চট্টগ্রামে আসা আমাকে বিস্মিত করেছিল। সাধারণত প্রেসিডেন্ট সফরে আসার এক মাস আগে ডিসিকে জানানো হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব হঠাৎ আমাকে ফোনে জানান রাজনৈতিক কারণে প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রামে আসছেন, থাকবেন মাত্র এক দিন। ৪৮ ঘণ্টার নোটিসে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। তার এই চট্টগ্রাম সফর ছিল বিএনপির দুই গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্য।

প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ২৯ মে সকালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে হাজির হই। বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি আর নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান বিমানবন্দরে ছিলেন। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা ছিলেন। সাধারণত চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুর প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রাম এলে উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু সেদিন তিনি সেখানে ছিলেন না। এটি একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তার বদলে ব্রিগেডিয়ার আজিজ ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আসার পর আমাদের সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। ব্রিগেডিয়ার আজিজকে প্রেসিডেন্ট জিয়া জেনারেল মঞ্জুরের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। আজিজ বললেন, টেনিস খেলত গিয়ে জিওসি ব্যথা পেয়েছেন, তাই আসতে পারেননি। জিয়া মুক্ত হেসে তখন আজিজকে শুধু বললেন, ‘মঞ্জুরকে বলো টেনিস একটু কম খেলতে।’

প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আমরা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যাই। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমি গাড়িতে বসলাম। প্রথমে কিছু বললেন না। যেতে যেতে প্রেসিডেন্ট হঠাৎ রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, মাঝখানের এই ডিভাইডার উঠিয়ে দিলে রাস্তা আরো প্রশস্ত হবে। আমাকে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলে ডিভাইডার তুলে দিতে বললেন।
আমি বললাম, ডিভাইডার তুলে দিলে ট্রাফিক-শৃঙ্খলা কঠিন হবে। উত্তরে তিনি বললেন, বাঙালিদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার জন্য এর প্রয়োজন। তারা রাস্তার এদিক-সেদিক চলতে পারবে না। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির সুরে বললেন, শৃঙ্খলা কীভাবে শিখবে! শুধু ৯ মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল বলে বাঙালি বুঝে উঠতে পারেনি। যদি ভিয়েতনামের মতো ২০ বছর যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হতো, তাহলে বুঝত।

প্রশ্ন : সার্কিট হাউসে পৌঁছার পর কী হলো?

জিয়াউদ্দিন : গাড়িতেই প্রেসিডেন্ট জানতে চেয়েছিলেন তার দিনের কার্যক্রম সম্পর্কে। সেদিন ২৯ মে শুক্রবার ছিল। আমি বললাম, প্রথমে চন্দনপুরা মসজিদে জুমার নামাজ আদায়। এরপর দুপুরের খাবারের পর তার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক। তিনি আর কিছু বললেন না। প্রেসিডেন্ট সার্কিট হাউসে পৌঁছালে সেখানে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে তাদের জানান জুমার নামাজের পর বৈঠক হবে। এরপর তিনি নিজ কামরায় গিয়ে নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেন। আমরা নিচে ছিলাম। তিনি নেমে এলে তাকে নিয়ে জুমার নামাজ পড়ার জন্য চট্টগ্রাম চকবাজার এলাকায় চন্দনপুরা মসজিদে চলে যাই। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একই গাড়িতেই ছিলাম। চন্দনপুরা মসজিদটি ১৮৭০ সালে নির্মিত। প্রাচীন এই মসজিদে পৌঁছালে ইমাম সাহেব প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নামাজের স্থলে নিয়ে যান। আমি তার পাশেই ছিলাম। খুতবা ও নামাজ শেষ হতে ঘণ্টাখানেকের কম সময় লাগল। নামাজ শেষে সার্কিট হাউসে ফিরে এলাম। আসার সময় প্রেসিডেন্টের গাড়িতে ছিলেন কমিশনার সাইফুদ্দিন সাহেব। এরপর দুপুরের খাবার খেলেন। খাবারের পর দলীয় বৈঠক শুরু হলো।