
আপনারা জুলাই মাসে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তো হলো না। বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রশ্নে এখনো সনদ আটকে আছে। কমিশনের মেয়াদ দুই দফা বাড়ানো হলো। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে কি এ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবেন?
আলী রীয়াজ: আশা করি পারব। সনদ নিয়ে কিন্তু আর আলোচনা হচ্ছে না। এখন বিষয়টা হচ্ছে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। এখন পর্যন্ত কিন্তু আমরা প্রকৃতপক্ষে মাত্র তিন দিন বসেছি। সাধারণভাবে বললে এর মধ্যেই কিন্তু একধরনের ঐকমত্য ইমার্জ করছি যে কতগুলো অপশন থাকবে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যেটা পাব, সেগুলো সমন্বিত করে হয়তো দু-তিনটা অপশন দেওয়ার কথা ভাবছি।
আমি খুব আশাবাদী, আমরা অক্টোবরের শুরুতেই বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে একটা জায়গায় আসতে পারব। সেটা মীমাংসা হয়ে গেলে সনদের প্রক্রিয়া শেষ হবে।
পৃথিবীতে একটিমাত্র দেশে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ আছে, সেটা হচ্ছে থাইল্যান্ড, আট বছর। আমরা তো ১০ বছর করেছি। প্রকৃতপক্ষে প্রস্তাবটা যখন আলোচনায় এল দুবার নাকি দুই মেয়াদ, তখন বিএনপির প্রতিনিধি বলেছেন, ১০ বছর করুন। এটা তো নেই পৃথিবীতে।
বিশেষজ্ঞদের একটা সুপারিশ আপনারা সর্বশেষ আলোচনার দিন দলগুলোকে দিয়েছেন। সেখানে বলা হচ্ছে, একটা সংবিধান আদেশ এবং পরবর্তী সময়ে ওই আদেশ নিয়ে গণভোট হতে পারে। ধরেন একটা সংবিধান আদেশ করা হলো। তার মানে সংবিধান সংশোধন হয়ে গেল। সংসদ হয়ে গেল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। আমরা ভোট করলাম। এখন সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে যদি কোনো কারণে সংবিধান আদেশ পাস না হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনের সাংবিধানিক ভিত্তি কোথায় থাকবে?
আলী রীয়াজ: না, দুটো তো আলাদা জিনিস। সংসদ নির্বাচন আর গণভোট —একটা আরেকটার বৈধতা দিচ্ছে না।
যখন আদেশটা জারি হবে, তার মানে হচ্ছে এটা কার্যকর হয়ে গেল। মানে দ্বিবক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষের। এখন যদি কোনো কারণে গণভোটে এই প্রস্তাব পাস না হয়, তাহলে এই যে নির্বাচনটা হলো, এটার বৈধতা কোথায় থাকবে?
আলী রীয়াজ: আপনারা ধরে নিচ্ছেন যে গণভোটে এটা পাস হবে না। ১৭৯০ থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো গণভোট হয়েছে, ৮০০-এর বেশি, তাতে মাত্র ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে গণভোট ফেল করেছে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আপনি যে বলছেন, ধরুন গণভোটে আমরা দেখলাম যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গৃহীত হয়নি। আপনি যে সংসদ নির্বাচন করছেন, সেটা কিন্তু নিম্নকক্ষের সংসদ বা জাতীয় সংসদ। এখন জাতীয় সংসদের দিন কী হবে? ওই দিন তো আর আপার হাউসের নির্বাচন হচ্ছে না। এটা পরে হবে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও নির্বাচনের বৈধতা প্রসঙ্গে

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ সামনে রেখেই আমরা নির্বাচন করছি। যেমন এখন চাইলে আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্টি সংসদে নির্বাচন করতে পারব না। সংবিধান আদেশ কার্যকর হলে তো দ্বিকক্ষ হয়ে যাবে। গণভোটে সেটা পাস না হলে সংসদ নির্বাচনের বৈধতা থাকে কি?
আলী রীয়াজ: অবশ্যই থাকে। বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, তার শেষ কথাটা ‘ভ্যালিডেটেড’ হতে হবে। রেফারেন্ডাম যদি ইনভ্যালিডেটেড হয়, অন্য অংশগুলো, তাহলে এটার ওপর কোনো ইমপ্যাক্ট পড়ে না। কারণ, এই যে অর্ডারের কথা তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কিন্তু নিম্নকক্ষের উল্লেখ নেই। ফলে নিম্নকক্ষ তো এমনিতেই এক্সিস্ট করছে।
এডিশনটা যদি ভ্যালিডেটেড না হয়, তাহলে এডিশন হবে না। শঙ্কাটা অন্য জায়গায়। ধরুন এত দিনের চেষ্টা, এত বিষয়ে ঐকমত্য হলো। তারপর জনগণের কাছ থেকে সেটা রিজেক্টেড হয়ে গেল। সে জন্য আমি বলি, ধরুন যে রিজেক্টেড যদি সত্যি সত্যি হয় জনগণের কাছ থেকে, সেটা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। আমরা বলছি যে জনগণের রায়ই চূড়ান্ত। চিলিতে দু-দুবার রেফারেন্ডাম ফেল করেছে।
আমি যে কথাটা বলেছি, ওনাদের হাত-পা ওখানে কেন? ধরুন পিএসসি রাষ্ট্রের। নির্বাহী বিভাগ অবশ্যই চাইবে এফিশিয়েন্ট, মেরিটের বেসিসে এটা হোক, তাই তো? নাকি চাইবে, আমার দলের লোক, আমি যাকে চিনি; তার যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক? এই প্রশ্নটার উত্তর আগে আমাকে দিন। তাহলে আমি উত্তরটা দিতে পারব, কী হাত–পা বেঁধে দিয়েছি?
ঐকমত্য কমিশনে যেসব সিদ্ধান্ত হলো যেমন একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না। সাংবিধানিক চারটা পদে নিয়োগ, এগুলোতে বিএনপির ভিন্নমত আছে। যেগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট আছে, এগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে?
আলী রীয়াজ: এগুলোর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, আমার ধারণা পরবর্তী সময় আলোচনার একটা স্কোপ থাকছে। এটা কমিশনের উদ্যোগে না, তাদের নিজেদের মধ্যে।
আরেকটা বিষয় আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। সেটা হচ্ছে জনগণের প্রত্যাশা। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রত্যাশাকে রিফ্লেক্ট করে। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক মানুষ মনে করেছিলেন, দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থাকা উচিত। তার প্রমাণ হচ্ছে, তাঁরা বিএনপিকে ভোট দিয়েছিলেন। বিএনপির ম্যানিফেস্টোতে তা ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, এই বিবেচনার বাইরে গিয়ে যখন লোকজন বলেছেন যে আমরা পার্লামেন্টারি সিস্টেমটা চাই, সিভিল সোসাইটি চেয়েছে, বিরোধী দল চেয়েছে, অন্যান্য নাগরিকেরা চেয়েছেন। তখন বিএনপি পার্লামেন্টারি সিস্টেমে গেছে।

সংবিধান আদেশ করা হলে সেখানে ভিন্নমতের বিষয়টি কীভাবে থাকবে?
আলী রীয়াজ: ধরুন আমরা যদি বলি যে সনদটাই যাচ্ছে। তাহলে কিন্তু ওইটার মধ্যে ইমপ্লাইড, যে এটার মধ্যে নোট অব ডিসেন্ট আছে, ভিন্ন মত আছে। আবার অন্যভাবে যদি আমরা ব্যাখ্যা করি, যদি জনগণ এই নোট অব ডিসেন্ট সত্ত্বেও মনে করে যে এটা বাস্তবায়ন করা দরকার, তাহলে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দল যারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তারা পুনর্বিবেচনা করবে।
ভারসাম্য-সংক্রান্ত প্রস্তাব, অর্জন কতটা
আপনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ছিলেন। আপনাদের লক্ষ্য ছিল, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং ভবিষ্যতে যাতে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র না হয় সেটা ঠেকানো। ভারসাম্য-সংক্রান্ত প্রস্তাব আপনারা যেভাবে করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আপনাদের লক্ষ্য কতো পূরণ হয়েছে?
আলী রীয়াজ: আমাদের লক্ষ্যের সবটাই পূরণ হয়েছে— এ রকম বললে যথাযথ হবে না। কারণ, অনেক বিবেচনা করেই তো সংবিধান সংস্কার কমিশন কতগুলো প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল। আমরা যেভাবে বিবেচনা করেছিলাম, সবটা অর্জিত হয়নি। কিন্তু কিছুই অর্জিত হয়নি, তা নয়।
এখানে বিএনপি বারবার বলেছে যে পিএসসি, দুদক, ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান আপনারা যেভাবে বলেছেন, সেভাবে করা হলে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়। আপনি এটা কীভাবে দেখেন?
আলী রীয়াজ: আমি যে কথাটা বলেছি, ওনাদের হাত-পা ওখানে কেন? ধরুন পিএসসি রাষ্ট্রের। নির্বাহী বিভাগ অবশ্যই চাইবে এফিশিয়েন্ট, মেরিটের বেসিসে এটা হোক, তাই তো? নাকি চাইবে, আমার দলের লোক, আমি যাকে চিনি; তার যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক? এই প্রশ্নটার উত্তর আগে আমাকে দিন। তাহলে আমি উত্তরটা দিতে পারব, কী হাত–পা বেঁধে দিয়েছি?
পিএসসির কথা আমরা বলছি। আপনি একটি দেশে যদি একটা এফিশিয়েন্ট ব্যুরোক্রেসি তৈরি করতে চান, যারা দেশ চালাবে। সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা থাকবে কেন? কেন প্রধানমন্ত্রীকে সেখানে হাত দিয়ে এটা নাড়াচাড়া করে ঠিক করতে হবে? এটার তো একটা প্রক্রিয়া থাকবে। সেই প্রক্রিয়াটা যতটা সম্ভব ট্রান্সপারেন্ট করেন। সেই প্রক্রিয়াটাতে নিশ্চিত করুন যেন এমন কিছু না হয়, যেটা আবার আপনার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, আপনি শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, আপনি নাগরিকও।
আমি খানিকটা রসিকতার সঙ্গে বলছি, খানিকটা সিরিয়াসলি বলছি, ওনাদের হাত-পা ওখানে থাকে কেন?
একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না, এটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিএনপি বলছে, সংসদীয় গণতন্ত্র আছে বিশ্বের এমন কোন দেশে এটি নেই। প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় প্রধান কে হবেন, তা ঠিক করার গণতান্ত্রিক অধিকার দলের।
আলী রীয়াজ: পৃথিবীতে একটিমাত্র দেশে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ আছে, সেটা হচ্ছে থাইল্যান্ড, আট বছর। আমরা তো ১০ বছর করেছি। প্রকৃতপক্ষে প্রস্তাবটা যখন আলোচনায় এল দুবার নাকি দুই মেয়াদ, তখন বিএনপির প্রতিনিধি বলেছেন, ১০ বছর করুন। এটা তো নেই পৃথিবীতে।
সংবিধান আদেশ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে যদি সংবিধান আদেশ হয়ে যায়, তার মানে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল?
আলী রীয়াজ: না।
সংবিধান আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকছে। এই আদেশটা হলে তো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরছে, নাকি?
আলী রীয়াজ: সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক যখন ভ্যালিডেটেড হচ্ছে, আপনারা ভ্যালিডেশনের জায়গাটা কিন্তু বাদ দিয়ে দিচ্ছেন, এটা আগে হবে।
আপনারা যে প্রস্তাব আলোচনায় তুলেছেন সেখানে বলা হয়েছে, এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
আলী রীয়াজ: কার্যকর হবে। তাতে করে যেটা হবে, এটা যতক্ষণ না ভ্যালিডেট, ততক্ষণ পর্যন্ত তো আপনি ইমপ্লিমেন্ট সবগুলো করতে পারবেন না। কনস্টিটিউশনাল অর্ডার সে জন্য স্পেসিফাই করা হচ্ছে।
ধরুন আজকে অর্ডারটা হলো, তাহলে কি জুলাই সনদ সংবিধানের পার্ট হয়ে গেল?
আলী রীয়াজ: পার্ট হওয়ার বিষয়টাতে কিন্তু লেখা আছে, পরবর্তী সময় এটা একটা...। কার্যকর হচ্ছে ওই অর্থে যে আপনি এর অধীনে, এর অন্তর্ভুক্ত যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলোর যে অঙ্গীকার, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে কালকেই যে একেবারে সংবিধান পরিবর্তিত হয়ে যাবে, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই।
যেভাবেই হোক, জুলাই সনদ নিয়ে যদি এ রকম একটি আদেশ অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করে, তাহলে কি এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করা যাবে? কারণ, জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে।
আলী রীয়াজ: এই সরকার নির্বাচন করতে পারবে ১০৬-এর (সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ) কারণে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মোরাল। পলিটিক্যালি যদি দেখেন, তাহলে এই সরকারের সবচেয়ে বড় বৈধতাটা কোথায়?
আমি সরকারের বৈধতার কথা বলছি না। যেহেতু একটা অর্ডার করে ফেলছেন, জুলাই সনদ কার্যকর। সেখানে বলা আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হবে। এই সরকার তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। তাহলে তারা কি নির্বাচন করবে নাকি আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর নির্বাচন করতে হবে?
আলী রীয়াজ: না, তা লাগবে না। এ কারণে যে এইটার মধ্যেই আপনি বলছেন, এইটা ভ্যালিডেটেড না হওয়া পর্যন্ত সবগুলো বিধান বাস্তবায়ন করছেন না। ভ্যালিডেট করতে হবে, আপনি জনগণের কাছে যাচ্ছেন। অর্ডারটা দেওয়া হচ্ছে ভ্যালিডেশনের জন্য। ফলে কালকেই আপনাকে সরকার বদলে ফেলতে হবে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট না করা পর্যন্ত কোনো নির্বাচন করা যাবে না, আমি তা মনে করি না।
কিন্তু যেটা আমি আবারও বললাম, আমাদের কথা হচ্ছে যে অন প্রিন্সিপাল এই জায়গাটায় যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়, তাহলে বা অন্ততপক্ষে একটা বিকল্প, আমরা সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তারপর এটার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে, সেগুলো মোকাবিলা করার চেষ্টা করব।
যদি তখন দেখি যে এটার গ্রহণযোগ্যতা নেই; তাহলে সেভাবে আমরা পুনর্বিবেচনা করব। এটাই শেষ কথা নয়।
জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও পরিসংখ্যানের যুক্তি
জুলাই সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে রাজনৈতিক দল। সে হিসেবে সনদ হচ্ছে জনগণের অভিপ্রায়। কিন্তু প্রশ্ন এসেছে, এই ৩০টা দলের বেশির ভাগেরই অতীতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাহলে কত শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব এখানে হচ্ছে বলে আপনারা মনে করছেন? এ বিষয়ে কমিশনের আলোচনায়ও কেউ কেউ কথা বলেছেন।
আলী রীয়াজ: এটা বারবার অনেকেই প্রশ্ন করছেন, নিবন্ধিত দল কিংবা গত নির্বাচন ইত্যাদি। খুবই ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি। নিবন্ধিত দল হিসেবে তো আমরা যখন প্রক্রিয়া শুরু করি, তখন আওয়ামী লীগ ছিল। আপনার কি মনে হয় যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল? আমি তো মনে করি না।
জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি নিবন্ধিত দল ছিল না। তাহলে কি আমাদের উচিত ছিল যে এনসিপি ও জামায়াতকে বাদ দিয়ে আলোচনা করা? আন্দোলনে তো তাদের ভূমিকা ছিল।
আমি এটা আরেকটু ব্যাখ্যা করি। কারণ, আমি এগুলো শুনছি। নির্বাচনে তারা ভোট পায়নি। সর্বশেষ নির্বাচনটা কবে হয়েছিল যেন? ২০০৮ সালটাকেও অনেকে বিতর্কিত বলেন। এখন রাস্তায় নামার সময় আমরা কি হিসাব করেছিলাম, আপনার জিরো পয়েন্ট ২ পার্সেন্ট সমর্থন আছে। আপনারা এই আন্দোলনে থাকবেন না।
এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না যে আপনি গত নির্বাচনে কত ভোট পেয়েছেন, সেই হিসাব অনুযায়ী আপনার চেয়ারের সাইজ ঠিক হবে আলোচনায়।
যারা এই যে হঠাৎ করে অঙ্ক শিখেছে, যে অঙ্ক আমি শিখতে পারি নাই। হঠাৎ করে পরিসংখ্যানবিদ হয়ে খুব স্ট্যাটিসটিকস দেওয়া শুরু করছে ৩২%, ১৮% কী কী সব পার্সেন্টেজ বলে। সোর্স কোথায়? কী মেথডে আপনি আসলেন? ৪০ পার্সেন্ট লোককে বাদ দিয়ে নাকি জাতীয় ঐকমত্য হচ্ছে! এই ৪০ পার্সেন্টের হিসাবটা আমাকে দেখান তো।
বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ আপনাদের আলোচনায়ও বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো আসলে শতভাগ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে না।
আলী রীয়াজ: পার্সেন্টেজের হিসাবে যাবেন না। হিসাব আপনি কোথা থেকে করবেন? গত নির্বাচনের ভোটের পার্সেন্টেজ? ২০১৪ সালের নির্বাচনে? বিএনপির সর্বশেষ অংশগ্রহণ করার নির্বাচন ২০১৮ সালে। আমি কি ওই পার্সেন্টেজ হিসাব করব? করা কি ঠিক হবে? তাহলে কিসের পার্সেন্টেজ বলছেন?
যারা এই যে হঠাৎ করে অঙ্ক শিখেছে, যে অঙ্ক আমি শিখতে পারি নাই। হঠাৎ করে পরিসংখ্যানবিদ হয়ে খুব স্ট্যাটিসটিকস দেওয়া শুরু করছে ৩২%, ১৮% কী কী সব পার্সেন্টেজ বলে। সোর্স কোথায়? কী মেথডে আপনি আসলেন? ৪০ পার্সেন্ট লোককে বাদ দিয়ে নাকি জাতীয় ঐকমত্য হচ্ছে! এই ৪০ পার্সেন্টের হিসাবটা আমাকে দেখান তো।
যে রাজনৈতিক দল ১৯৪৭ সালে এই দেশে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছে, ছয় বছর পর এসে একটি নির্বাচনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
এই সংখ্যাতত্ত্বের, পরিসংখ্যানের পার্সেন্টেজের যে হিসাব, এগুলো খুবই ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের ক্রাইটেরিয়া হবে, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার লড়াইয়ের সংগ্রামে কারা প্রাণ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই সমানভাবে দাঁড়ান নাই, এটা ঠিক। একটা মৃত্যু, একজনের শাহাদাতবরণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আবু সাঈদ কোন দল করতেন, সেই প্রশ্ন আপনি তুলবেন? তুলতে চান ওয়াসিম কোন দল করত?
রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে কি জনগণের মতামতের জায়গা আছে? অবশ্যই আছে। প্রত্যেকটা কমিশন আলাদাভাবে কিন্তু সিভিল সোসাইটির সঙ্গে মিট করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এক লাখের বেশি লোকের মতামত নিয়েছিল। ৩০-৪০টার বেশি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
বিএনপি–জামায়াত–এনসিপির ভিন্ন অবস্থান
একধরনের অভিযোগ ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়ও উঠেছে, বিএনপিকে আপনারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আলী রীয়াজ: পারসেপশন তো আমরা তৈরি করতে পারব না। দেখে কারও কারও মনে হতে পারে। আবার যেমন ধরুন কেউ কেউ তো অন্য কথাও বলেছে। এখন কে, কীভাবে পারসিভ করল, সমস্ত কিছু তো প্লেইন সাইটে হয়েছে। কমিশন কি আসলেই কারও প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছে? তেমন কি ঘটনা ঘটেছে? তা তো নয়। কারও কারও মনে হয়েছে, মনে হতেই পারে।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিন ধরনের মতামত দিয়েছে। এই মতভিন্নতার কারণে সনদ ভেস্তে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা বা আগামী নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়তে পারে কি না?
আলী রীয়াজ: নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আমি বলব না। কারণ, এখনো অনেক সময় আছে। নির্বাচনের জন্য এক দিনও অনেক লম্বা সময়। সনদের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী, সনদের মূল বিষয় নিয়ে কিন্তু কেউ আপত্তি তুলছে না। আমি আশা করি সবাই স্বাক্ষর করবে। কিন্তু দেখুন স্বাক্ষর করার এই প্রত্যাশার পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার, এগুলোর ব্যাপারে কিন্তু সবার জ্ঞাতসারে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। কাগজে সই না করলেই তা থেকে তারা বেরিয়ে যেতে পারবে কি? আমি তো তা মনে করি না।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল যারা আলোচনায় আছে এখনো, তারা জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনসহ কয়েকটি দাবিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করেছে। বিএনপি বলছে, এটা স্ববিরোধিতা। এই বিষয়টা কীভাবে দেখেন?
আলী রীয়াজ: আমরা কমিশনের বাইরের যে রাজনৈতিক কার্যক্রম, সেগুলোকে কেবল দলীয় কার্যক্রম বলে বিবেচনা করি এবং এটা যতক্ষণ না পর্যন্ত কমিশনের ফোরামে উত্থাপিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কোনোরকম মানে অবস্থান বা মন্তব্য করব না। কারণ, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে বিভিন্নভাবে তাদের কর্মসূচি করা।
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখছেন না
রাজপথের আন্দোলন বা কর্মসূচির কোনো প্রভাব ঐকমত্য কমিশনে পড়বে?
আলী রীয়াজ: এখন পর্যন্ত পড়েনি। আমরা আশা করছি, বাকি যে সময়টা আছে, সেটাতেও পড়বে না।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। জাতি আপনাদের কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা দেখেন?
আলী রীয়াজ: আমি এখন পর্যন্ত কোনো অনিশ্চয়তা দেখি না। আমি যেটা মনে করি, ফেব্রুয়ারিতে অবশ্যই নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচন না হলে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে, সে রকম পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা একধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে। একধরনের বিপদ তৈরি করতে পারে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে। সবাইকেই একসঙ্গে আসতে হবে। সরকারকে কঠোর অবস্থান নিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করে, সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনটা যেন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আলী রীয়াজ:আপনাকেও ধন্যবাদ।