
‘‘আর্মি দায়িত্বে থাকলে আগামী নির্বাচনে আর গণ্ডগোল হবে না, নির্বাচনটা ভালো হবে। আওয়ামী লীগ আমলে সেনাবাহিনীতে যারা নির্বাচনী দায়িত্বে ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে ইয়াং জেনারেশনকে দায়িত্ব দিলে তারা ভালো করবে।‘‘
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব:) নুরউদ্দীন খান বলেছেন, ভারতের সাথে আমরা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চাই। তবে এটা একতরফা হতে পারে না। উভয় দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থকে দেখতে হবে। ভারতের সিদ্ধান্তের কারণেই তাদের হাসপাতালে বাংলাদেশী রোগী আর পাওয়া যাচ্ছে না, ভারতীয় বাজার বাংলাদেশী ক্রেতাশূন্য হয়ে গেছে। একদিন না একদিন ভারত বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার গুরুত্ব বুঝবে। অন্য দেশ হিসেবে আমেরিকা, চীন ও মিয়ানমার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক রাখতে হবে। এমনকি আরাকানের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন।
গতকাল নয়া দিগন্তকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, বড় দল হিসেবে বিএনপির নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে ঐক্য ঠিক রাখতে পারলে দেশের অন্য রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে ঐক্যের সৃষ্টি হবে। তিনি রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা থেকে সবার শিক্ষা নেয়া উচিত।
সাবেক সেনাপ্রধান নুরউদ্দীন বলেন, আর্মি দায়িত্বে থাকলে আগামী নির্বাচনে আর গণ্ডগোল হবে না, নির্বাচনটা ভালো হবে। আওয়ামী লীগ আমলে সেনাবাহিনীতে যারা নির্বাচনী দায়িত্বে ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে ইয়াং জেনারেশনকে দায়িত্ব দিলে তারা ভালো করবে। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় দেশের শাসনভার গ্রহণ না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় আমি চেয়েছিলাম দেশে গণতন্ত্র আসুক।
সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
নয়া দিগন্ত : সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন দেখছেন, একটা রাজনৈতিক ঐক্যের অভাব মনে হচ্ছে...
জেনারেল নুরউদ্দীন খান : নাইনটিন নাইনটিওয়ানে যখন আমি সেনাপ্রধান ছিলাম ম্যাডাম খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী। নাইনটি ফোর পর্যন্ত আমি সেনাপ্রধান। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিএনপিকে আমার খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওনাকে আমি দীর্ঘ চারটি বছর দেখেছি। ওনার যে ধৈর্য, ওনার যে দেশপ্রেম, ওনার যে ন্যাশনাল স্পিরিট, ওনার যে স্যাক্রিফাইস, ওনার যে সহনশীলতা, অতুলনীয়। আমরা ভাগ্যবান যে ওনার মতো একজন গার্জিয়ান বাংলাদেশ পেয়েছে। তার দল বিএনপির প্রতি আমার একটা অনুরোধ থাকবে ওনার যে সমস্ত এক্সাম্পল, যেসব অত্যাচার উনি সহ্য করেছিলেন, যে ধৈর্য উনি প্রকাশ করেছেন, বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল হয়ে তার কিছু নমুনা আমাদেরকে প্রদর্শিত করতে পারে।
নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক দলের মধ্যে অস্থিরতা থাকলে এর প্রভাব তো বাইরে এসেও পড়ে...
নুরউদ্দীন খান : আজকে বিএনপি বহু সমস্যায় ভুগছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। বিএনপির মধ্যে নিজেদেরই ঐক্য নাই। দূর-দূরান্ত থেকে ঘটনার পর ঘটনা ঘটছে আমরা পেপারে দেখতে পাচ্ছি। বিএনপির বড় বড় নেতারা যারা আছেন, তারা আমার বন্ধু, আমি তাদের সবারই খুব ঘনিষ্ঠ, তাদের প্রতি অনুরোধ রইল আপনারা দয়া করে দলটাকে ঐক্যবদ্ধ করেন। আপনাদের দল ঐক্যবদ্ধ হলে আপনাদের দেখাদেখি বাকি যত দল আছে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। এইটা আমার আশা।
নয়া দিগন্ত : নির্বাচন তো ঘনিয়ে আসছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি শেষ করতে বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান...
নুরউদ্দীন খান : ১৯৯১ সালে একটা ইলেকশন হয়েছিল। আপনাদের মনে থাকার কথা তখন আমার একটা ক্ষুদ্র অবদান ওই ইলেকশনে ছিল। তখন জাস্টিস সাহাবুদ্দিন আহমেদ প্রেসিডেন্ট। বিচারপতি আব্দুর রউফ তখন চিফ ইলেকশন কমিশনার। ওই ইলেকশনে সাহাবুদ্দিন আহমেদ আমাকে বলেছিলেন হোম মিনিস্ট্রির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ইলেকশনটা করার দায়িত্ব আপনার। আমি আশা করি আপনারা মনে করে দেখতে পারেন একটা ভালো ইলেকশন হয়েছিল। আমি এখানে নিজে একটু কৃতিত্ব নিতে চাই। আমি চাই সেই ধরনের ইলেকশন ভবিষ্যতে আরো হোক। ওই ধরনের ইলেকশন করতে হলে আর্মির প্রয়োজন, শুধু পুলিশ পারবে না, আনসার পারবে না। কিন্তু গত পনের বছরে আর্মিতে একটু প্রবলেম হয়ে গেছে আপনারা জানেন। এখন যারা নতুন কমান্ডাররা এসেছেন, পুরাতন যারা চলে গিয়েছেন। তাদের পরে যারা নতুন কমান্ডাররা দায়িত্ব পেলেন এরা খুব দেশপ্রেমিক। নতুন যারা যারা কমান্ড পেয়েছেন তাদের আন্ডারে আমি আশা করি ইলেকশনটা ইনশা আল্লাহ খুব সঠিকভাবে হবে, যদি সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
নয়া দিগন্ত : তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের কথা উঠেছিল, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
নুরউদ্দীন খান : নিরাপত্তা নিয়ে একটা কথা, সেটা হলো ১৮ কোটি লোকের দেশ। গত বিপ্লবে তরুণরা প্রমাণ করেছে তারা সাহসী। এই ধরনের ছেলেমেয়ে থাকলে দেশের ডিফেন্স কোনো সমস্যাই নয়। শুধু হিম্মত করে আমাদের একটা ন্যাশনাল আর্মি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অর্থ লাগবে; কারণ অর্থ ছাড়াতো নিরাপত্তা হবে না। এটার এক্সাম্পল চায়নাতে আছে। এক্সাম্পল সুইজারল্যান্ডে আছে, ১৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত যারা তারা দেশের সেনাবাহিনীর আন্ডারে ট্রেনিং করে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা তৈরি হতে ত্যাগ স্বীকার করে। এমন ন্যাশনাল আর্মি করতে পারলে আমাদের নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের বর্তমানে আর্মির যে ১০টি ডিভিশন আছে, যদি প্রত্যেকটি ডিভিশনকে আমরা এক হাজার তরুণকে প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব দেই তাহলে এক বছরে ১০ হাজার তরুণের প্রশিক্ষণ হয়ে যাবে। এভাবে আমাদের শক্তি সামর্থ্য বাড়াতে হবে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কোনো ব্যক্তি বিশেষের দায়িত্ব নয়। এখানে একটা শিক্ষিত সমাজের টিম থাকতে হবে। দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থাকতে হবে, কেয়ারিং থাকতে হবে; তাদের দিয়েই এই কাজটি করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : আপনি গত এপ্রিলে ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ভূকৌশলগত স্বার্থে আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
নূরউদ্দীন খান : হ্যাঁ, ভূকৌশলগত স্বার্থে নজর রাখতে হবে। কারণ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অস্বীকার করা যাবে না। উপেক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে আমাদের গুরুত্বের স্বীকৃতি রয়েছে বিশ্বের পরাশক্তি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আমাদের সমস্যা রয়েছে প্রতিবেশী ভারতের সাথে। ভারতের সাথে আমরা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চাই। তবে এটা একতরফা হতে পারে না। উভয় দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থকে দেখতে হবে। ভারত একদিন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার গুরুত্ব বুঝবে। আমাদের নেপাল, ভুটানের, অরুনাচলের সাথে বিকল্প বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নেয়া প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে থিংকট্যাংকগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ সরকারকে নানা রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হয়। এর পাশাপাশি থিংক ট্যাংকগুলোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে জাতীয় স্বার্থে আরো গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারে।
একই সাথে আমাদের, তেল ও গ্যাস সম্পদ অনেক বড় ফ্যাক্টর। অন্যান্য দেশ হিসেবে আমেরিকা, চীন ও মিয়ানমার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক রাখতে হবে। এমনকি আরাকানের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। চীন আমাদের খুবই ভালো বন্ধু। দেশটিতে আমি প্রথম মিলিটারি ডেলিগেশন নিয়ে যাই ১৯৭৮ সালের অক্টোবরে। এরপর থেকে চীন ট্যাংক, গান ও অন্যান্য অস্ত্র সরঞ্জাম আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য দিয়েছে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আজ কিংবা কাল হয়ে যাবে। ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ এই নীতি এখন সময়োপোযোগী এবং এ লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।