Image description

সংস্কার, জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজ, বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স, সাবেক এপিএসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। রাজধানীর হেয়ার রোডে তাঁর সরকারি বাসায় গতকাল শুক্রবার এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ ও আসিফ হাওলাদার।

প্রথম আলো

শুরুটা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে হওয়া উচিত। এখন যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটি আপনার বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স। আপনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর কী বলবেন?

আসিফ মাহমুদ: অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন যে এটা (বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স) অপরাধ কিংবা অন্যায়। দুঃখ প্রকাশ করার কারণে হয়তো এ ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের আইনে এটা অপরাধ বা অন্যায় কোনোটাই নয়। কেননা ঠিকাদারি লাইসেন্স করা বা যেকোনো ব্যবসায়জড়ানো সবার নাগরিক অধিকার। যেহেতু লাইসেন্সটি ব্যবহার করে কোনো কাজ নেওয়া হয়নি, সেহেতু এটি স্বার্থের সংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) মধ্যেও পড়ে না। তবে স্বার্থের সংঘাত হওয়ার আশঙ্কার জায়গা থেকে আমি দুঃখ প্রকাশ করেছি। পরে বাবার আবেদনে লাইসেন্সটি বাতিল করা হয়েছে।

প্রথম আলো

আপনি দুঃখ প্রকাশের পর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা আলোচনা হচ্ছে যে প্রভাব ছাড়া এত দ্রুত লাইসেন্স পাওয়া বাংলাদেশে খুব কঠিন। আপনার জবাব কী হবে?

আসিফ মাহমুদ: লাইসেন্সটা হয়েছে আমাদের জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে এবং এই লাইসেন্সের বিষয়টা জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী পর্যায়েই আসলে নিষ্পত্তিযোগ্য।...সেই পর্যায়ে যখন একটা সিদ্ধান্ত হয়, আমার অফিশিয়ালি সেটা জানার উপায় নেই। আনফিশিয়ালিও আমি এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না অথবা বাবার কাছে থেকেও আমার এ বিষয়টি জানা হয়নি।

সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া
সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো

আপনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথম প্রজ্ঞাপনে লেখা ছিল যে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরে শুনলাম তিনি পদত্যাগ করেছেন। আসলে বিষয়টি কী?

আসিফ মাহমুদ: সংশোধিত প্রজ্ঞাপন এসেছে। পদত্যাগপত্রের কপিটাও হয়তো আপনারা পেয়েছেন। ২৫ মার্চ সম্ভবত পদত্যাগপত্রটা আমাদের মন্ত্রণালয়ে জমা হয়। ঈদের ছুটির পরে পদত্যাগের আবেদনটা গ্রহণ করি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে অব্যাহতির কথাটা লেখা ছিল। সংশোধিত প্রজ্ঞাপন ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা আছে যে পদত্যাগের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অব্যাহতি। এখানে একটা ‘মিসকমিউনিকেশন’ হয়েছিল।

মোয়াজ্জেমের যখন নিয়োগ হয়, তখনই তিনি আমাকে বলেছিলেন স্থায়ী চাকরির সুযোগ এলে তিনি এই চাকরি (এপিএস) ছেড়ে দেবেন। তাঁর ব্যাংকে চাকরির ভাইভা (মৌখিক পরীক্ষা) এগিয়ে আসছে। বিসিএসেরও লিখিত পরীক্ষা সামনে। সেই জায়গা থেকে মোয়াজ্জেম পদত্যাগের আবেদন করেন এবং আমি তা গ্রহণ করি।

বাবার ঠিকাদারির লাইসেন্স ছিল, জানিয়ে ক্ষমা চাইলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

 

প্রথম আলো

কিন্তু মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে বদলি–বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আসছে। আপনি কি আপনি মনে করেন, একটা স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত?

আসিফ মাহমুদ: তদন্ত হওয়া উচিত এবং তদন্তের জন্য ইতিমধ্যেই আমরা দুদককে (দুর্নীতি দমন কমিশন) বলেছি। যেহেতু এখন তিনি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত নন, সুতরাং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে এটা তদন্ত করার সুযোগ নেই। তিনি একজন স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা। সেই জায়গা থেকে আমরা দুদককে অনুরোধ করেছি যে আপনারা এটা তদন্ত করুন। মন্ত্রণালয় থেকেও সাধারণ মানুষের কাছে অভিযোগ চাওয়া হয়েছিল। তবে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আসলে আমরা পাইনি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার একান্ত সচিবের ব্যাপারেও আমরা তদন্ত করতে বলেছি।

প্রথম আলো

আপনার এলাকা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির নেতা–কর্মীরা ৮ এপ্রিল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, আপনি এলাকায় আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন করছেন।

আসিফ মাহমুদ: মুরাদনগরে বিএনপি নেতারা এটাকে একধরনের কাদা–ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু মুরাদনগরে আমার স্বার্থটা রাজনৈতিক নয়। আপনারা জানেন, দীর্ঘ সময় ধরে কুমিল্লার ব্যাপারে শেখ হাসিনার একধরনের ক্ষোভ ছিল। অনেক রাস্তাঘাটের কাজ হয়নি। আমার একটু নজর ছিল সেদিকে কিছু করার। বঞ্চিত নানা অঞ্চল নিয়ে আমরা কাজ করছি।

কুমিল্লায় কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, ৫ আগস্টের পর স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজি, দখলদারত্ব, মাদক, বালু-মাটিসংক্রান্ত ঝামেলা আছে। সেগুলো ৫ আগস্টের পরে একই রকম রয়ে গেছে, শুধু হাতবদল হয়ে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের হাতে এসেছে। চাঁদাবাজি নির্মূল করতে গিয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে বিএনপি নেতার খুব কাছের একজনের নেতৃত্বে থানায় হামলা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এটাকে তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে দেখানোর চেষ্টা করেন যে আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিএনপিকে নিপীড়ন করছি। এটাকে যেভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এটা ছিল সম্পূর্ণ একটা চাঁদাবাজির ঘটনা।

সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেমের বিষয়ে দুদককে তদন্তের অনুরোধ করেছি: উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

 

প্রথম আলো

পরে ওই সংবাদ সম্মেলনের পাল্টা হিসেবে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন হয়। যেখানে আপনার বাবাকে দেখা গিয়েছিল। এ বিষয়টি নিয়ে কী বলবেন?

আসিফ মাহমুদ: আসলে পরের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টা আমি অতটা জানতাম না। বাবার ছবি দেখার কারণে পরে জানতে পারি। বাবাকে বলি যে এটাতে তো আপনার যাওয়া...। সেই সংবাদ সম্মেলনটা যারা করেছিল, তারা আসলে স্থানীয় বিএনপিরই আরেকটা গ্রুপ।

সাক্ষাৎকারের একটি মুহূর্ত
সাক্ষাৎকারের একটি মুহূর্ত
প্রথম আলো

আপনি শুরুতে ছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ে, যেখানে শ্রমিকদের জীবন মানোন্নয়নে, বৈষম্য নিরসনে কাজ করার সুযোগ ছিল। সেখান থেকে স্থানীয় সরকারে আপনি কেন এলেন? এই মন্ত্রণালয় অনেক আগে থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচিত। সেখানে দুর্নীতি দমনে আপনি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

আসিফ মাহমুদ: শ্রম মন্ত্রণালয়ে আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, সে সময়টা ছিল ট্রানজিশন পিরিয়ড (পরিবর্তনকাল)। তখন শ্রম খাতের পরিস্থিতি ভালো ছিল না। অনেক আন্দোলন, অনেক কিছু আপনারা দেখেছেন। সেগুলোকে আমরা ট্যাকেল (সামাল) দিয়েছি। পরে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চেয়েও দপ্তর-সংস্থাগুলোর দুর্নীতিতে ভালো নাম-খ্যাতি আছে। যেমন ওয়াসা। ওয়াসাতে ফ্যাসিস্ট সময়ে তাকসিম (তাকসিম এ খান) সাহেব ছিলেন। তাঁর দুর্নীতির খবর আমরা প্রতিনিয়তই পেতাম। সিটি করপোরেশনগুলোতেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে।

এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা বড় দুর্নীতির একটি জায়গা খুঁজে বের করি। সেটা হলো, প্রকল্পে মাত্রাতিরিক্ত প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা। যেমন পাঁচ-ছয় কিলোমিটার খাল পরিষ্কার করার জন্য ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প রাখা হয়েছিল। যেটা আসলে পাঁচ কোটি টাকারও কাজ নয়। সেই প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো আমরা বাতিল করে দিয়েছি এবং অনেকগুলো প্রকল্প আমরা পর্যালোচনা করার মাধ্যমে ব্যয় কমিয়েছি। আমাদের সব দপ্তর, সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য প্রায় সব প্রকল্পের বাজেট পর্যালোচনা করা হয়েছে। অনেকগুলো প্রকল্পের খরচ কমিয়ে আনা হয়েছে।

দুর্নীতির আরেকটি বড় জায়গা নিয়োগ। সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেমন ওয়াসাতে আমরা সরাসরি কাউকে নিয়োগ না দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। সংস্থাটির নিয়োগে যেন কোনো প্রকার দুর্নীতি না হয়, সে জন্য আমরা বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে বোর্ড গঠন করেছি।

রমজানে কিংবা এখন পর্যন্ত দ্রব্যমূল্যটা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। দ্রব্যমূল্য কমায় একটা স্বস্তি তৈরি হয়েছে। তবে যেহেতু চাকরি-কর্মসংস্থান ও অর্থের প্রবাহ বাড়েনি, মূল্যস্ফীতি কমেনি, ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সময়টা এখনো চ্যালেঞ্জিং।
প্রথম আলো

কিন্তু এ–ও তো দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী পদে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে।

আসিফ মাহমুদ: প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বোর্ড আছে এবং ওই বোর্ডটা প্রিজাইড (সভাপতিত্ব) করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব। এই বোর্ডে অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা আছেন। সবার স্বাক্ষর ছাড়া আসলে ওই নিয়োগটা, এমনকি আমার টেবিলে ফাইল আসা সম্ভব নয়। সবার স্বাক্ষরের ভিত্তিতে আমার এখানে ফাইল এলে আমি শুধু সই করি। আমি আমার সচিবকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি বোধ হয় ৩ নম্বর ছিলেন। প্রথম যিনি ছিলেন, তাঁর চাকরির মেয়াদ ছিল সাত দিন। জ্যেষ্ঠ দ্বিতীয় জনের মেয়াদও বেশি দিন ছিল না। এ জন্য তৃতীয়জনকে বোর্ড সুপারিশ করেছে। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা নিয়োগটা দিয়েছি।

প্রথম আলো

ঢাকায় ব্যাপক মশার উৎপাত। সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম আসছে। ঢাকা ওয়াসার পানিতে সাম্প্রতিক কালে পোকা পাওয়া যাচ্ছে। আপনি কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

আসিফ মাহমুদ: ঢাকা ওয়াসার পানির বিষয়ে আমরা প্রকৌশলীদের পাঠিয়েছি। তাঁরা খোঁজ করে দেখেছেন, আমাদের সরাসরি লাইনের পানিতে কোনো পোকা নেই। পরে পরিদর্শন করে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট বাসার পানির ট্যাংক দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না। ফলে সেখানে পোকা জমে। আমরা পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছি।

ডেঙ্গুর সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। ডেঙ্গু দমনে যে ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেটা ততটা ইফেক্টিভ (কার্যকর) নয়। এমনকি আমি যেখানে (হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবন) থাকি, এখানেও সন্ধ্যার পরে যে পরিমাণ মশা থাকে...।

বিভিন্ন দেশে একদম লার্ভা অবস্থাতেই ডেঙ্গুর ৯০ শতাংশ মশা ধ্বংস করে ফেলার কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা তা বাংলাদেশে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।

পরিদর্শন করে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট বাসার পানির ট্যাংক দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না। ফলে সেখানে পোকা জমে। আমরা পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছি।
প্রথম আলো

রাজনৈতিক বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে একটা আলোচনা ছিল যে এটা জাতীয় নির্বাচনের আগে হবে। সর্বশেষ অবস্থাটা কী এবং সরকার কী মনে করে?

আসিফ মাহমুদ: বিষয়টি তো আলটিমেটলি স্টাক (স্থবির) হয়ে আছে। জাতীয় ঐকমত্য নষ্ট হয়, এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত সরকার এককভাবে নিচ্ছে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্ত অবস্থান দেখেছি। জামায়াতে ইসলামী, গণ অধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ অনেকগুলো দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে বলছে। তবে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে নয়। সরকার এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আরেকটু দেখতে চায় যে এ বিষয়ে ঐকমত্য হয় কি না।

হাস্যোজ্জ্বল উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
হাস্যোজ্জ্বল উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো

জাতীয় নির্বাচন নিয়েও দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন অবস্থান দেখা যায়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার বলেছেন যে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। বিএনপি বলছে, তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেন?

আসিফ মাহমুদ: সরকারের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে করার মতো কিছু নেই। আমি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে যতটুকু জেনেছি, তিনি ম্যান অব ওয়ার্ড (কথা দিয়ে কথা রাখার মানুষ)। উনি যে সময় বলেছেন, সেটা রাখবেন। আমরা সেই সময়সীমা ধরেই কাজ করছি। এমনকি জুন ধরেও না, কাজগুলো যাতে ঠিকমতো এগোয়, সে জন্য ডিসেম্বর ধরে কাজ করছি। সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে, সদিচ্ছা দেখালে দ্রুত নির্বাচন সম্ভব।

প্রথম আলো

দেখা যাচ্ছে, সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য হয়নি। প্রধান দলগুলো একমত না হলে সংস্কারের ভবিষ্যৎ কী?

আসিফ মাহমুদ: সব দলেরই নিজস্ব মতামত আছে। আমি যতটুকু দেখেছি, অন্তত ৬০–৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে সবাই একমত পোষণ করেছে। কিছু কিছু বড় প্রশ্নে, যেমন দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন—এমন কিছু বিষয়ে দ্বিমত আছে। একটা বিষয় হলো, বাংলাদেশে মূল সংস্কার বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা না হলে যে গণতন্ত্রের কথা বলছি, জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে বেটার বাংলাদেশের কথা বলছি, তা কঠিন হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। এক ব্যক্তির হাতে প্রশ্নহীন ক্ষমতা ফ্যাসিজম অথবা স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। পৃথিবীতে এমন বহু উদাহরণ আছে। আমার মনে হয়, বড় দল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর এ ক্ষেত্রে আরও উদারতা দেখানো উচিত। সত্যিকার অর্থে কল্যাণরাষ্ট্র গড়তে মূল সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐকমত্যে আসা উচিত।

প্রথম আলো

আপনি কি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন?

আসিফ মাহমুদ: এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি।

বিভিন্ন ইস্যুতে করা প্রশ্নের উত্তর দেন আসিফ নজরুল
বিভিন্ন ইস্যুতে করা প্রশ্নের উত্তর দেন আসিফ নজরুলছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো

নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অভিযোগ করেছে, অনেক জায়গায় মাঠ প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। আপনি সরকারের অংশ। এ অভিযোগের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

আসিফ মাহমুদ: এনসিপি যে অভিযোগ করেছে, তা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। কারণ, বাংলাদেশের প্রশাসন তো পেশাদারি নয়, এটার ধরনটা এমন যে এটা একটি রাজনৈতিক দলকে ‘সার্ভ’ করে। প্রশাসন, পুলিশ কোনোটাই আসলে পেশাদারিভাবে প্রশিক্ষিত নয়। তারা বিগত সময়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে সার্ভ করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়েছে। সামনে যে ক্ষমতায় আসতে পারে, মাঠ প্রশাসনের সেদিকে ঝুঁকে থাকার একটা প্রবণতা আছে। কোনো কোনো কর্মকর্তাকে আমরা দেখেছি, এ–সংক্রান্ত বক্তব্যও দিচ্ছেন। তবে পেশাদার কর্মকর্তাও আছেন। তাঁরা সংখ্যায় ২০–৩০ শতাংশ হতে পারেন।

প্রথম আলো

আওয়ামী লীগ বিষয়ে একটি প্রশ্ন করি। নির্বাহী আদেশে দলটি নিষিদ্ধ হয়নি। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করার মতো সময় পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, সেটা নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে কী আলোচনা হয়? আপনার ব্যক্তিগত মত কী?

আসিফ মাহমুদ: উপদেষ্টা পরিষদের আলোচনার বিষয়ে আমি বলতে পারব না। আমার গোপনীয়তার শপথ রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত। পৃথিবীতে বহু উদাহরণ আছে যে গণহত্যাকারী দলকে রাজনীতি করতে দেওয়া হয়নি। নিষিদ্ধ করার অনেক প্রক্রিয়া আছে, তবে এখনো ‘ডিসাইসিভ’ নয় (সিদ্ধান্ত হয়নি)। বিচারিক প্রক্রিয়ার কথা আমরা বলতে পারি না, কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন। নিবন্ধন বাতিল করা নির্বাচন কমিশনের বিষয়।

প্রথম আলো

শেষ প্রশ্ন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমজীবী মানুষ ব্যাপকভাবে যোগ দিয়েছিলেন। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই শ্রমজীবী। আমরা দেখছি, ছাত্রনেতাদের অনেকের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে দৃশ্যমান কোনো আয় ছাড়া। কিন্তু সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের দৃশ্যমান পরিবর্তনে আপনারা আসলে কী পদক্ষেপ নেবেন?

আসিফ মাহমুদ: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব অংশের, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশগ্রহণ ছিল। শহীদদের মধ্যেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটাই বেশি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর একটা ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে শুরু করে বিনিয়োগ কোনো কিছুই স্বাভাবিক থাকে না। আমি মনে করি, আট মাস পরে অর্থনীতির চাকা ভালোভাবে সচল হয়েছে। রমজানে কিংবা এখন পর্যন্ত দ্রব্যমূল্যটা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। দ্রব্যমূল্য কমায় একটা স্বস্তি তৈরি হয়েছে। তবে যেহেতু চাকরি-কর্মসংস্থান ও অর্থের প্রবাহ বাড়েনি, মূল্যস্ফীতি কমেনি, ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সময়টা এখনো চ্যালেঞ্জিং। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, দেনা পরিশোধসহ আমাদের আর্থিক খাতে যেভাবে সুখবর আসছে, উন্নতি হচ্ছে, আমি মনে করি, ছয় মাসের মধ্যে আমরা আরও বেটার করতে পারব।