Image description
 

অধ্যাপক আসিফ নজরুল অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপনার আগে তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন।

লেখক হিসেবে ড. আসিফ নজরুল অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছিলেন সক্রিয়। বর্তমানে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ ছাড়া সরকারের নীতিনির্ধারণী নানা ধরনের কাজের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। অধ্যাপক আসিফ নজরুল আমার দেশ কার্যালয়ে এসেছিলেন সোমবার। তার সঙ্গে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ইফতারে আরো যোগ দিয়েছিলেন শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম, অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।

ইফতার শেষে আমার দেশ-এর মাল্টিমিডিয়া স্টুডিওতে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. আসিফ নজরুল নির্বাচন, সংস্কার কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ফ্যাসিস্টদের বিচার প্রক্রিয়ার নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমার দেশ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী

আমার দেশ : ড. আসিফ নজরুল আমার দেশ অফিসে আপনাকে পেয়ে আমরা খুব আনন্দিত। আমার দেশ এক্সক্লুসিভ অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। শুরুতেই আপনার অনুভূতি জানতে চাচ্ছি।

ড. আসিফ নজরুল : আজকে আমাদের একটা ইফতার পার্টি ছিল। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আমাদের খুব প্রিয় একজন মানুষ। তার দেশপ্রেমের জন্য, সাহসী ভূমিকার জন্য। তিনি আজ স্নেহভাজন কয়েকজনকে ইফতারের জন্য অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

আমরা আসলাম, খুব ভালো লাগল। এত ছোট একটি অফিস থেকে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে এমন একটি পত্রিকা বের করছেন, আপনারা যে কোয়ালিটির রিপোর্ট, যে ইনডেপথ রিপোর্ট করছেন, মাহমুদুর রহমান ভাইয়ের মন্তব্য প্রতিবেদনগুলো ইতোমধ্যে প্রত্যাশিতভাবে অনেকের নজর কেড়েছে। আমি মাহমুদ ভাইকে বলি- এক বছরের মধ্যে আমার দেশকে দেশের প্রধান দৈনিকে পরিণত করতে হবে, এটা ওনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা এবং বিশ্বাস। আমার দেশ অফিসে এলে মনে হয়, নিজের আত্মীয়র বাসায় এলাম, নিজের পরিবারের কাছে এলাম।

আমার দেশ : আপনি নিজে একসময় সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একসময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করেছেন, আমি তখন দৈনিক বাংলায় ছিলাম। তখন থেকেই আপনার সঙ্গে পরিচয়। মিডিয়ার সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আপনি এমন একটা সময়ে সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

এ ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আপনার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দেশবাসী এটা জানে, যে কজন মানুষ তখন সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে উৎখাতের জন্য, তাদের মধ্যে আপনি অন্যতম। আপনি সংক্ষিপ্তভাবে ওই সময়কার আপনার অবস্থান এবং ভূমিকা নিয়ে একটু বলেন… যদিও আপনি এ বিষয়ে আগে বহুবার কথা বলেছেন, এখন আমাদের দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে যদি কিছু বলেন…

ড. আসিফ নজরুল : আমি খুব সংক্ষেপে বলি- ১৫ বছর ধরেই অন্যায়-অবিচার দেখলে সহ্য হতো না। বাংলাদেশের প্রত্যেক সরকারই কম-বেশি অন্যায় করত। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনকালে অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন, মিথ্যাচার, ভারততোষণ- এগুলো এমন একপর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে নিজের বিবেকের তাড়নায় চুপ থাকতে পারতাম না। অনেক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৪০ জন ছেলে মিছিল করছে, একমাত্র আমি ছিলাম শিক্ষক হিসেবে। তখন খুব দুঃখ লাগত, আমাদের কি বিবেক মরে গেছে! আমাদের ইয়াং জেনারেশন কোথায়, তাদের বিবেক কোথায়? নাগরিক সমাজ কোথায়?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালের ছবিগুলো যখন দেখি, তখন মনে হয়, আমার সেই দুঃখ চলে গেছে। একটু আগে মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে নামাজ পড়ছিলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, এক বছর আগে এটা অকল্পনীয় ছিল। এখানে আমাদের ভূমিকা নিয়ে বড় করে বলার কিছু নেই। সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো বাংলাদেশের জনগণের, ছাত্র-জনতার। আজকে আমরা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, মাহফুজ আলম, আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহকে দেখি, আমি এখন বলি যে নামগুলো আমরা জানি, তারাই কিন্তু আন্দোলনের অগ্রণী মুখ, চেনা মুখ।

কিন্তু ওনাদের মতেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওনাদের চেয়েও বেশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমার চেয়েও শতগুণে বেশি অবদান রেখেছে নাম না জানা সাধারণ মানুষ, মরে গেছে আমরা জানি না তাদের। প্রত্যেকটা মানুষ হিরোতে পরিণত হয়েছিল তখন, প্রত্যেকটা মানুষ মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এ রকম অভূতপূর্ব ঘটনা জীবদ্দশায় দেখব, এটা ভাবতে পারিনি। আপনি জানেন, ১৯৮২ সাল থেকে আমি সাংবাদিকতা করি, দেশের খবর রাখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় আন্দোলন হয়নি। এত বড় আন্দোলনের একটা ছোট্ট অংশ যে ছিলাম, এটাই জীবনে সবচেয়ে বড় শান্তি।

আমার দেশ : এ সরকারের প্রায় সাত মাস হয়ে গেল। এই সাত মাস পর আপনার কাছে কি মনে হয়, জুলাই আন্দোলন এখন রাইটট্রাকে আছে?

ড. আসিফ নজরুল : অবশ্যই আছে। শোনেন, একটা জিনিস হয় কি, আমি সবাইকে অনুরোধ করব। দেখেন, আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অবস্থা দেখেন, কী রকম অবস্থা হয়! আজকের সিরিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখেন, মিডেল ইস্টের দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন। তিউনিসিয়াকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম, আরব বসন্ত একমাত্র তিউনিসিয়ায়ি সফল হয়েছে। কী অবস্থা হয়ে যে, দেখেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশে কী অবস্থা হয়েছিল, চিন্তা করেন। সেটার তুলনায় আমরা এখনো খারাপ অবস্থাতে নেই, ভালোই আছি। আমি একটি জিনিস বলি, সরকারে আসার পর টের পেলামÑ শেখ হাসিনা ১৫ বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমি বাড়িয়ে বলছি না, সময় থাকলে আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলতে পারতাম।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে উনি ধ্বংস করে তিনি নিজেই একক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। প্রত্যেকটা সিস্টেমকে ধ্বংস করে তিনি নিজে একাই একটা সিস্টেমে পরিণত হয়েছিলেন। ওনার চোখের ইশারাই হচ্ছে, সংবিধানের ভাষা, ওনার তর্জনী হচ্ছে শাসনের ভাষা। উনি যখন জনগণের রুদ্ররোষের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তারপর ওই সিস্টেমটাও চলে গেছে। প্রতিষ্ঠান তো ধ্বংস করে গেছেন, খুবই কুৎসিত একটা সিস্টেম ছিল- সেটা শেখ হাসিনা নিজে, সেটা চলে গেছে। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা কাজ করছি। আমি জানি, আপনাদের কাছে মনে হবে যে একটা এক্সকিউজ দিচ্ছি। কিন্তু পরিচিত যারা সরকারে কাজ করে, খবর নিয়ে দেখেন…।

এটাও না হয় বাদ দেন, বিচার বিভাগের দিকে তাকান। কী অবস্থায় ছিল, পুলিশ কী অবস্থায় ছিল বলেন! সেটাকে এ রকম রেডিক্যালি চেঞ্জ করে একটা জনমুখী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা অনেক বড় টাস্ক, আমি এক্সকিউজ দিচ্ছি না। কয়েকটা জিনিস আপনাদের বলতে পারি খুব গর্বের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার শাসনামলের পার্থক্য হচ্ছে- আমাদের সরকারে থাকা কোনো মানুষ অসৎ না, আমাদের কোনো হীন পলিটিক্যাল এজেন্ডা নেই, আমরা নির্যাতন করি না। আমার নামে কত অবমাননাকর কথাবার্তা পোস্ট হয়।

কিন্তু আমরা সে জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ অন্য কোনো আইনে কোনো মামলা করিনি। শেখ হাসিনার আমলে সরকার, পুলিশ গায়েবি মামলা করত- এ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো গায়েবি মামলা করা হয়নি। যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো সাধারণ মানুষ করেছে, সরকার করেনি। আমরা অত্যাচারী না, আমরা মিথ্যাবাদী না, আমরা অসৎ না। একটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখে, আমাদের যতটা সফল হওয়া উচিত ছিল, ততটা পারছি না।

আমার দেশ : আপনারা হয়তো সেগুলো করছেন না। কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি বারবারই উচ্চারিত হয়, আপনারা সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি, কেবিনেটে যারা আছেন, তাদের অনেকের ব্যাপারে এ ধরনের অভিযোগ আসে…

ড. আসিফ নজরুল : হতে পারে। কিন্তু আপনাকে একটা জিনিস বলতে চাই, আমরা কি সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছি? আর আগের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো ছিল, তাদের কী কাজ ছিল? সমস্ত প্রতিষ্ঠান সুদৃঢ়ভাবে আছে, সবাই মিলে হেল্প করছে, একটা নির্বাচন করে দিয়ে তারা চলে যেত। জাস্ট রুটিন ফাংশন। কিন্তু আমাদের কাজ অনেক ব্যাপক।

তা ছাড়া আমাদের এই কাজে তো কারো অভিজ্ঞতা ছিল না। তারপরও সবাই মিলে চেষ্টা করি। আমাদের ভুল থাকতে পারে, আমরা চেষ্টা করি। ভুল থাকলে লজ্জা পাই, স্বীকার করি, আবার চেষ্টা করি এবং সারা দিন-রাত কাজ করি। শনিবার করি, মাঝে মাঝে শুক্রবারও অফিস করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, ওখানে পরিশ্রম ওত ছিল না। দিনে কখনোই বোধহয় ৪-৫ ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করতাম না আগে। এখন কমপক্ষে ১২-১৪ ঘণ্টা প্রতিদিন পরিশ্রম করি।

আমার দেশ : এখন আপনারা পরিশ্রম করেন, আমরা সম্প্রতি দেখেছি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাত ৩টার সময় সংবাদ সম্মেলন করছেন, ভোরেও থানা ভিজিট করছেন। ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন যদি কন্ট্রোলে না আসে, আপনারা যে পরিশ্রম করছেন এটার রেজাল্টটা তো পাওয়া গেল না। এবার সত্যিকারভাবে রোজার সময় জিনিসপত্রের দাম অনেকটা কমেছে, অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনা বলেন বা সামগ্রিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, আপনি একজন সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে কী মনে করেন?

ড. আসিফ নজরুল : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত বড় মনস্তাপের বিষয়। আমাদেরও পরিবার আছে, পরিবার থেকে অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা শুনি, বন্ধু-বান্ধব থেকে কঠোর সমালোচনা শুনি। আমি শুধু আপনাদের বলব, এ সময়ে বিশেষভাবে খারাপ হয়েছে, আবার ধরেন গত দুই মাসে এত খারাপ ছিল না। ইনশাআল্লাহ এক মাস পর পরিস্থিতি আবার ভালো হবে। এটা কার্বের মতো আছে।

এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় যে কারণটা আপনাদের বারবার বলি, দেখেন আমরা একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশ সার্ভিস দিয়ে কাজ করছি। আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় বিবেচনায় অনেকে নিয়োগ পেয়েছিল, অনেকে হতোদ্যম অবস্থায় আছে, সাহস পায় না। আমরা যখন কিছুদিন আগে একটা মিটিং করেছিলাম, উদাহরণ হিসেবে আপনদের বলি, আমাদের পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা বলেছেন- ‘আমাদের পুলিশ কী করবে বুঝতে পারে না। পুলিশ দিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ঠেকানো যায় না, যারা রাস্তাঘাট আটকে রাখে তাদের মারবে নাকি পরাজয় স্বীকার করে চলে আসবে বা কতটা মানবিক হবে বুঝতে পারে না।’

শেখ হাসিনার আমলে পুলিশ এক রকম ছিল। ওদের ডিএনএর মধ্যে ছিল পিটাও, এটা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। ছাত্রলীগ বা নিজের দলের লোক হলে কিছু বলবে না, অন্য দল হলে পিটাও। কোনো নির্দেশ দিতে হতো না। এখন আমাদের সমস্যাটা হয় কী, আমরা যদি বলতে যাই পুলিশকে যে ঠিক আছে আগের মতো পিটাও। তখন… বলল যে না, মেয়েদের কোনোভাবেই পেটানো যাবে না, ছাত্রদের পেটানো যাবে না, সাংবাদিকদের পেটানো যাবে না, হুজুরদের পেটানো যাবে না। -তাহলে পুলিশ তো জানেই না কীভাবে ডিল করবে। পুলিশকে বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো এ রকম একটা সময়ের মুখোমুখি হতে হয়নি। যেখানে সারাজীবন খালি পেটায়, সেখানে এখন বিক্ষুব্ধ মানুষের ভিড়, কারণ মানুষ অনেক বেশি স্বাধীন এখন।

মানুষের ভেতরে অনেক বেশি যন্ত্রণা, ১৫ বছরের দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামছে। এত দাবি, ২০০-৩০০ মিছিল হয়েছে এর মধ্যে, আন্দোলন হয়েছে ঢাকার শহরে। এই আন্দোলন ফ্রিকোয়েন্ট আন্দোলন, এত মুক্ত মানুষের আন্দোলনকে ট্যাকল করার মতো অভিজ্ঞতা তো পুলিশের নেই। তাদের একটাই অভিজ্ঞতা, পেটানো। এখন আমরা বলিÑ পুলিশকে সহনশীল হতে হবে।

আমার দেশ : তাহলে কী মানবিক পুলিশ হতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে?

ড. আসিফ নজরুল : সেটা তো আছে, আরেকটা হচ্ছে এক্সপেক্টেশন ম্যানেজমেন্ট। এখন ধরেন যারা শেখ হাসিনার ভয়ে ১৫ বছর যে যৌক্তিক কথাগুলো বলতে পারেনি, তারা এখন সবকিছু নিয়ে রাস্তায় নামছে। নামছে, ভালো। ওরা তো নামবে, কিন্তু আমাদের সরকারের সামর্থ্য যেটা, শেখ হাসিনা তো সব লুট করেও নিয়ে গেছে।

আমার দেশ : পুলিশে লোকবল নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও তো সেভাবে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না…

ড. আসিফ নজরুল : পুলিশে লোক নিয়োগ যত তাড়াতাড়ি করেন না কেন, কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগে। আমাদের ফাস্ট ব্যাচ মাসখানেকের মধ্যে রিক্রুটেড হয়ে প্র্যাকটিস শুরু করছে।

আমার দেশ : সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে। আপনারা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

ড. আসিফ নজরুল : এ ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্সের ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত শাস্তি আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না, বিচার কেন নিশ্চিত করতে পারছি না, সে ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবছি। আমার দায়িত্ব আমি পালন করব। এখন পুলিশের দায়িত্ব তারা পালন করার চেষ্টা করছে, ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

ধর্ষণ কেন, নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদে যখন আলোচনা করি, আমাদের যত যন্ত্রণা, আমাদের যত কষ্ট যে আমরা আরো অনেক কিছু করতে পারছি না, আমরা এটাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারছি না, এটা যদি দেখাতে পারতাম, আপনারাও শান্তি পেতেন, আমরাও শান্তি পেতাম। আমরা অব্যাহতভাবে চেষ্টা করে যাব।

ঐতিহাসিকভাবে আমাদের সমাজে নারীরা ভালনারেবল। কিন্তু আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে, যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের ছাত্রীরা, মেয়েরা ও নারীরা, তাদের আত্মত্যাগ কোনোভাবেই ভাষায় ব্যক্ত করে শেষ করা যাবে না। তারা প্রথম সারিতে ছিল, প্রথম মিছিলটি ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার’ এই মিছিল তো মেয়েরা করেছে। তাদের হাতে গড়া এই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের আমলে এসব ঘটনা ঘটে, এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার, দুঃখের ও কষ্টের। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাব, ইনশাআল্লাহ যতটা পারা যায় আমরা ব্যবস্থা নেব।

আমার দেশ : শেখ হাসিনাসহ স্বৈরাচারের দোসরদের বিচার কতটুকু এগোলো?

ড. আসিফ নজরুল : প্রায়ই বলা হয় শেখ হাসিনাসহ স্বৈরাচারের দোসরদের, বিচার হচ্ছে না, বিচারে ঢিলেমি হচ্ছে… আপনাকে আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জঘন্য বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার। তাদের বিচারের ক্ষেত্রে এভারেজে আড়াই বছর লেগেছে। আপনি তো সাংবাদিক, আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি? আড়াই বছর লাগছে যে বিচার, সে বিচার আমি কেমনে ছয় মাসে করব? এই বিচার আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমাদের প্রসিকিউশন টিম আছে, ইনভেস্টিগেশন টিম আছে, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বাত্মক দ্রুততার সঙ্গে এই টিমগুলো গঠন করে দিয়েছি। আমাদের গণপূর্ত উপদেষ্টা এবং আমি নিয়মিত পরিদর্শনে যেতাম, যেন কোর্ট ভবনটা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়। ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন তৈরি হতে কমপক্ষে তিন মাস লাগবে। আমরা বলেছি, তিন সপ্তাহে করতে হবে।

আমরা প্রতিদিন মনিটর করে এটা করেছি। আমরা অনেক চেষ্টা করি, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করি। এক্সপেক্টেশন ম্যানেজমেন্ট, আনপ্রিসিডেন্টলি হাই হয়ে গেছে মানুষের এক্সপেক্টেশন, মানুষের প্রতিবাদ করার ভাষা, প্রতিবাদ করার সুযোগ, এত রকম বঞ্চনা, এত রকম টেনশন সমাজে। তারপর ডিপ্রেসড পুলিশ ফোর্স, বিচার বিভাগে সমস্যা আছে। আমাদের চেষ্টার তুলনায় কাজের ভলিউমটা অনেক বেশি, সে জন্য মনে হচ্ছে আমরা তেমন কাজ করছি না।

আমার দেশ : আপনি অতি সম্প্রতি জেনেভায় গিয়েছিলেন, সেখানে জাতিসংঘ শেখ হাসিনা ও তার সহযোগী যারা জুলাই গণহত্যায় জড়িত ছিল, তাদের ওপর একটি ডিটেইলস রিপোর্ট দিয়েছে। জেনেভার অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করেন?

ড. আসিফ নজরুল : জেনেভায় ভলকার তুর্ক ছিলেন। ওনারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে জুলাই গণহত্যা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করেছেন। কী ইনভেস্টিগেশন করেছেন সেটা জানতাম না। জাতিসংঘ রিপোর্ট আমাদের প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী করেছে। কারণ এখানে অনেক প্রমাণ আছে।

জাতিসংঘ তদন্ত করে দেখেছে যে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। এখন ভিডিও ফুটেজ বের হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন, মানুষ মারার জন্য। আমরা চ্যালেঞ্জ করলাম, এই ভিডিওগুলোর সত্যতা যে কেউ যাচাই করতে পারেন। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় প্রমাণ করে দেখেন সত্য কি না।

আমরা শতভাগ কনফিডেন্ট, এগুলো সত্য ঘটনা। আমাদের কাছে আরও এভিডেন্স আছে, চাঞ্চল্যকর এভিডেন্স আছে। বিচারের স্বার্থে সেগুলো এখনই প্রকাশ করছি না। আমরা মনে করি, যেই অপরাধ হয়েছে, তার সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করার মাধ্যমেই হাসিনাসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের যথোপযুক্ত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে।

আমার দেশ : শেখ হাসিনা বা তার সহযোগীদের বিচারে কত দিন সময় লাগতে পারে?

ড. আসিফ নজরুল : একটা ইন্টারভিউতে এ রকম যখন মানুষ জিজ্ঞেস করে, আমি বলেছিলাম আশা করছি, একটা টাইম বলে দিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পছন্দ করেনি। তারা বলেছে, এ ধরনের কথা যেন আমাদের পক্ষ থেকে না বলা হয়। ওনারা তো ইমপার্শিয়াল। এ কথাটা তো প্রমাণ, এই যে কথাটা বলেছে আদালত থেকে। আইনমন্ত্রী কী বলছেন, ওনারা কেয়ার করছেন না। আইনমন্ত্রীও যেন এ ধরনের কথা না বলেন।

আমার দেশ : আইনের শিক্ষক হিসেবে বা আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হিসেবে যদি বলেন।

ড. আসিফ নজরুল : আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হিসেবে আমি যেটুকু জানি সেটা হলোÑ তদন্ত শেষে চার্জশিট হয়ে, চার্জ ফ্রেম হয়ে একদম শুনানি পর্যায়ে যে বিচারকাজ, সেটা ইনশাআল্লাহ মে মাসে শুরু হয়ে যাবে। যেহেতু অত্যন্ত অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, জীবন্ত প্রমাণ রয়েছে। এটা জাস্ট আমার ধারণা, মে মাসে যদি শুরু হয়, ইনশাআল্লাহ হয়তো আমরা আশা করতে পারি এরপর কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো রায় হতে পারে। আমি আবার বলছি, এটা আমার ধারণা, অ্যাসেসমেন্ট; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

আমার দেশ : বিচার বিভাগের বিষয়ে জানতে চাই, মানুষের একটা আগ্রহ আছে, বিচারপতিদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল যে, তারা মানুষের প্রতি জুলুম করেছেন, অন্যায় করেছেন, এমনকি ঘুস-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ রকম প্রমাণও আমরা বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় দেখেছি। কিন্তু বিচার বিভাগের সংস্কার কি সেই পর্যায়ে হয়েছে? এখন পর্যন্ত কী আমরা এটা বলতে পারি?

ড. আসিফ নজরুল : আপনি যদি উচ্চ আদালতের কথা বলেন, আপিল বিভাগের তো সমস্ত জজই চলে গেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের তো প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার। ওনারা যারা সম্মানিত মানুষ, ওনাদের এখতিয়ারের ব্যাপারে যখন প্রশ্ন করেন আমি আনইজি অবস্থায় পড়ি। আমি শুধু এটুকু বলি, উনি ওনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন।

১২ জনের ব্যাপারে ইতোমধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে ওনারা হয়তো আরো নিতে পারেন। আর কিছু জজ তো রিটায়ার্ড করে গেছেন। উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, সেটা প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে ওনারা যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, এর চেয়ে বেশি কিছু নেওয়ার আছে বলে আমি মনে করি না। যদি আপনি আইনগতভাবে দেখেন।

আমার দেশ : সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমরা জানি, ইতোমধ্যে মূল যে ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট দিয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে আপনারা অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এখন জুলাই চার্টারের মাধ্যমে সংস্কারের একটি রূপরেখা আপনারা দিয়ে যেতে চাচ্ছেন। এই সংস্কারগুলো, এই জুলাই চার্টার চূড়ান্ত রূপ নিতে কত দিন সময় লাগতে পারে?

ড. আসিফ নজরুল : একটা জিনিস বলি, আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সবগুলো রাজনৈতিক দলই সংস্কার চায়। সমস্যাটা কোন জায়গায়? কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, সংস্কার বাস্তবায়ন করে কি নির্বাচন? তাহলে তো নির্বাচন দেরি হয়ে যাবে! আবার কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, না, সংস্কার করেই নির্বাচন করা উচিত। না হলে নির্বাচনের পর যে দল জিতবে সে হয়তো সংস্কার করবে না। বিরোধটা এই জায়গায়। সবাই সংস্কায় চায়, কম আর বেশি।

আমার দেশ : আরো দু-একটা বিষয় আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী যেটা জোর দিয়ে বলছে, পিআর পদ্ধতির ভোটের কথা, বিএনপি যেটার সঙ্গে একমত না আবার ছাত্ররা বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে করতে হবে।

ড. আসিফ নজরুল : সব ক্ষেত্রেই সমঝোতা সম্ভব। পিআর (আনুপাতিক হারে) নির্বাচন, বিএনপি যদি বলে ৫০০ আসনে নির্বাচন, সবাই যদি রাজি হয়, ঠিক আছে ১০০ আসনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, আর বাকি ৪০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন… এটা উদাহরণ হিসেবে বললাম। আমি বলছি, মধ্যপথে আসার জায়গা আছে। এ জন্যই তো জাতীয় ঐকমত্য কমিশন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যা বলেছে- এটা সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী না।

দুটোর মধ্যে মধ্যবর্তী জায়গা সম্ভব। আবার ধরেন ছাত্ররা বলেছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে। আমার ধারণা, বিএনপি এটাতে মিস আন্ডারস্ট্যান্ড করেছে। ১৯৭০ সালে নির্বাচনটা পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল, ওই পার্লামেন্ট একসঙ্গে গণপরিষদের কাজ করত। ছাত্ররা যেটা বোঝাতে চেয়েছে, আমার সঙ্গে যখন কথা হয়, বিএনপির সঙ্গেও কথা কথা হয়; তারা (ছাত্ররা) যেটা বোঝাতে চায়, তা হলো সামনে যে সংসদ নির্বাচন হবে... ধরেন ৩০০ জন নির্বাচিত হলো। এই ৩০০ জন পার্লামেন্টের কাজও করবেন, আবার গণপরিষদের কাজও করবেন।

এটা খুব সোজা ব্যাপার। তারা যখন পার্লামেন্ট হিসেবে বসবেন, তখন ’৭২-এর সংবিধানের যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো সেটা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে করবে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটিতে, যত দিন পর্যন্ত নতুন সংবিধান প্রণীত না হয়। গণপরিষদ এই ৩০০ জনই সপ্তাহে দুদিন বা এক দিন বা দিনের কোনো একটা সময়, ধরেন সন্ধ্যার পর দুই ঘণ্টা তারা গণপরিষদ হিসেবে বসবেন। গণপরিষদ হিসেবে যখন বসবে, তখন তার এজেন্ড হবে নতুন সংবিধান রচনা করা।

আমার দেশ : বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান সংবিধানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্তও যদি আপনি পরিবর্তন করতে চান, নির্বাচিত পার্লামেন্টের মাধ্যমে গণপরিষদ নামটা ব্যবহার না করেই এটা করতে পারেন। এখানে বাধা কোথায়? গণপরিষদ হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে, এটা বলা হচ্ছে।

ড. আসিফ নজরুল : বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে না। আজকে যদি ছাত্ররা, বিএনপি, জামায়াত, বাম দলগুলো একসঙ্গে বসে, ওনাদের যদি নিয়ত সবার ভালো থাকেÑ কোনো বিভ্রান্তি হওয়ার কথা না।

আমার দেশ : আপনি তাহলে এখনো আশাবাদী যে একটা সমঝোতায় আসা সম্ভব হবে?

ড. আসিফ নজরুল : অবশ্যই, অবশ্যই আমি আশাবাদী। এখন যদি সমঝোতা নাও হয়, কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতা হবে। আমরা যখন সবশেষ মিটিংয়ে বিএনপির সঙ্গে বসলাম, ওখানে সালাহউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘অন্তত ৫০ শতাংশ তো আমরা এগ্রি করব।’ আমার কথা হচ্ছে, ১০০টা জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন।

যদি ৩০টা জায়গায়ও করতে পারি, তাও তো অ্যাচিভমেন্ট। কিছু কাজ কিন্তু আমরা অলরেডি করেছি। পাসপোর্ট করার জন্য পুলিশের ভেরিফিকেশন লাগবে না, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির জন্য পাসপোর্ট লাগবে না, গুম কমিশন গঠন, আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী কনভেনশনে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ হয়েছি- এগুলো কি সংস্কার না? বাংলাদেশের মতো একটা গুম করা দেশ, যে দেশ মানুষকে গুম করে হত্যা করে শেখ হাসিনার আমলে, সে দেশ গুমবিরোধী কনভেনশনে পক্ষ রাষ্ট্র হয়েছে, এগুলো সংস্কার না? উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যে আইন করেছি আমরা, এটা সংস্কার না? অচিরেই দেখবেন আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিভিল এবং ক্রিমিনাল মামলায় দ্রুততর বিচার করার জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব আনা হবেÑ সবই সংস্কার। কোনোটা বড় সংস্কার, কোনোটা ছোট সংস্কার। বড় সংস্কার যেগুলো, ধরেন প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের বেশি থাকবেন না। এখানে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার।

আমার দেশ : এগুলোর ক্ষেত্রে বিএনপির যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব ছিল, তার অনেকগুলো এই সুপারিশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীও সংবাদ সম্মেলন করে যেগুলো ঘোষণা করেছে, সেগুলোর অনেক হয়েছে। এগুলো একটা কমপাইলেশন, এগুলো করতে কত দিন সময় লাগতে পারে? ডিসেম্বরের মধ্যে সম্ভব কি না?

ড. আসিফ নজরুল : নিয়ত যদি ঠিক থাকে, ছয় মাসে সম্ভব। সংস্কারগুলো মূলত আইনগত সংস্কার, নীতিগত সংস্কার, সাংবিধানিক সংস্কার। এগুলো পেপারওয়ার্ক, আপনি যখন অ্যাগ্রি করবেন পেপারওয়ার্কটা তো হয়ে যাবে। ধরেন আমরা অ্যাগ্রি করলাম, একটা নতুন প্রতিষ্ঠান জন্ম দেব। প্রতিষ্ঠানটা জন্ম দিতে হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু যখন অ্যাগ্রি করবেন, আইনটা হয়ে যাবে, ফাউন্ডেশনটা তো হয়ে যাবে। সমস্ত ফাউন্ডেশন বা কিছু ক্ষেত্রে কমপ্লিশন কাজটা ছয় মাসের মধ্যে সম্ভব, নিয়ত সবার ভালো থাকলে।

আমার দেশ : অধ্যাদেশ করে তো সংবিধান সংশোধন করতে পারবেন না।

ড. আসিফ নজরুল : পারব, পারব। একটু শোনেন, আপনার মনে আছে, জিয়াউর রহমানের আমলে, এরশাদের আমলে সব মার্শাল ল রেভল্যুশনারিগুলো করা হয়েছে। আমি অধ্যাদেশ দিয়ে করতে পারি, আপাতত ওটা সংবিধানবিরোধী থাকে। কিন্তু যদি পরবর্তী সরকার এসে রেকটিফাই করে, ভেলিডিটি দেয়... চাইলে করা যায়। তবে আমি বলছি না এটাই বেস্ট পন্থা।

আমার দেশ : আমাদের সামনে মনে হয় বড় একটা উদাহরণ একাদশ সংশোধনী এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে যদি সবগুলো দল একমত হয়, আপনি একাদশ সংশোধনীর মতো পরে সংসদে এটা পাস করতে পারেন।

ড. আসিফ নজরুল : এক্সজেক্টলি। আমাদের তো একাদশ সংশোধনী রয়েছে। একজন সিটিং প্রধান বিচারপতি এসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গেছেন। আমার কথা হচ্ছে নিয়ত। আপনার যদি নিয়ত ঠিক থাকে, পদ্ধতি বের করার জন্য আইন মন্ত্রণালয় আছে, সরকার আছে। পদ্ধতি বের করা কোনো সমস্যা না।

আমার দেশ : আপনার মনে হয়, তাহলে কবে নির্বাচন হবে?

ড. আসিফ নজরুল : আমার মনে হয়, এটা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ডিসেম্বরের মধ্যে করা। কোনো কারণে যদি এক সপ্তাহ-দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ সময় বেশি লাগে হয়তো লাগতে পারে। আমাদের মোটামুটি লক্ষ্য আছে ডিসেম্বরে করা। যদি আরেকটু সময় লাগে চার-পাঁচ সপ্তাহ বড়জোর। এরকম হতে পারে আরকি…

আমার দেশ : সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

ড. আসিফ নজরুল : আমি এই প্রসঙ্গে যেতে চাচ্ছি না। অন্য প্রসঙ্গে বলেন…

আমার দেশ : আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ সব বিষয়ে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এখানে উপদেষ্টা পরিষদ এক্সপানশনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব…

ড. আসিফ নজরুল : আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের এক্সপানশন বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। রাইট নাউ করা হবে, এ ধরনের কোনো আলোচনা আমি শুনিনি। প্রধান উপদেষ্টা যখন প্রয়োজন মনে করছেন, বিশেষ সহকারী নিয়োগ করছেন। উপদেষ্টা পরিষদের ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আলোচনা না করে সাধারণত করেন না, ওইভাবে আলোচনা নেই এখন।

আমার দেশ : আপনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন। প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি খুবই আলোচিত, তাদের দাবির মধ্যে এটা একটা জোরালো দাবি। এটা নিয়ে আপনারা কী চিন্তা করছেন?

ড. আসিফ নজরুল : প্রবাসীদের ভোটাধিকারের জন্য আমরা অত্যন্ত রেসপেক্টফুল। আমরা মনে করি, প্রবাসীদের অবশ্য ভোটাধিকার থাকা উচিত। এখানে অনেক বড় একটা টেকনিক্যাল সমস্যা আছে, তারা কী পদ্ধতিতে ভোট দেবেন। আমাদের ব্যাপকসংখ্যক প্রবাসী রয়েছেন, তারা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, সোচ্চার এবং দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন, দেশের জন্য অনেক ত্যাগ করেন।

টেকনিক্যাল দিকটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তারা কনফিডেন্ট ফিল করলে আমরা পলিসি ডিসিশন নিতে পারি। অবশ্যই, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়া হবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দেওয়া উচিত। এখন যদি নির্বাচন কমিশন বলে আমি টেকনিক্যালি প্রিপিয়ার্ড আছি, আমি পারব করতে, এটা নিয়ে কন্টোভার্সি হবে না। তাহলে অবশ্যই হবে। নির্বাচন কমিশন যদি বলে, না আমার সেই টেকনিক্যাল ক্যাপাসিটি নেই, টেকনোলজিক্যাল ক্যাপাসিটি নেই। তখন আমার ইচ্ছা দিয়ে তো কিছু হবে না। এটা আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। আমি টেকনিক্যাল বিষয়ে কম বুঝি, আমি আইনগত বিষয় বুঝি।

আমার দেশ : সংস্কার প্রস্তাব বা জুলাই চার্টার করার পর লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক কী হবে? অ্যাগ্রিড হওয়ার পর আইনগত ভিত্তিটা কীভাবে দাঁড় করাবেন আপনারা?

ড. আসিফ নজরুল : চার্টারের ভেতরে তো অনেক ইস্যু থাকবে, এসব ইস্যুতে আমরা ঐকমত্য হলাম। ইস্যু বেইজ আইন হবে। যেখানে আইন করা দরকার, সেখানে আইন করব, যেখানে পলিসি করা দরকার, সেখানে পলিসি করব, যেখানে সংবিধান সংশোধনী করা প্রয়োজন, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো বসে ঠিক করবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা পরবর্তী সংসদ বাস্তবায়ন করবে। আবার তারা বলতে পারে, যেহেতু সবাই একমত হয়েছি, ধরেন তারা বলল, ৭০ অনুচ্ছেদটা মডিফাই করতে হবে, আপনারা অধ্যাদেশের মাধ্যমে করে ফেলেন পরবর্তী সংসদে রেটিফাই করব।