
ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায় জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হয়েছেন গার্মেন্টসকর্মী মো. পারভেজ মিয়া (২৬)। যন্ত্রণা আর অনটনে জর্জরিত পারভেজ এখন বাড়িতে হুইলচেয়ারে দিন কাটাচ্ছেন। চিকিৎসার খরচ, সংসারের ব্যয় সামলাতে না পেরে স্ত্রী আড়াই মাসের সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছেন। অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চাইতে গিয়ে হয়েছেন চরম অবহেলার শিকার।
রবিবার (৬ জুলাই) সকালে নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে নিজের এই দুর্বিষহ জীবনের কথা তুলে ধরেন জুলাই যোদ্ধা মো. পারভেজ মিয়া। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার কুশমাইল ইউনিয়নের ধামর বেলতলী গ্রামে। বাবা গোলাম মাওলা পেশায় একজন এম্বুলেন্স চালক। দুই ভাই, এক বোনের সংসারে এখন শুধু অভাব আর দীর্ঘশ্বাস।
পারভেজ বলেন, ‘পেটে গুলি খেয়েছি। মরে যেতে পারতাম। মরি নাই, তবে মরে যাওয়াই ভালো ছিল। এখন পঙ্গু হয়ে গেছি, অসহায় জীবন কাটাচ্ছি। স্ত্রী আড়াই মাসের মেয়েসহ বাপের বাড়ি চলে গেছে। হুইলচেয়ারেই দিন কাটে। খাবারও নিজের হাতে খেতে পারি না।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, সকাল ১০টার দিকে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে আন্দোলনকারী জনতা ব্যারিকেড দেয় বিজিবির গাড়িবহরের সামনে। দুপুর একটার দিকে বিজিবি সদস্যরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পারভেজের তলপেটে গুলি লাগে। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দুই ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিলেন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে আলহেরা হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচার করে তার পেট থেকে গুলি বের করা হয়।
এরপর তিন মাস ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নেন পারভেজ। দুইবার পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে, কিন্তু বাম পা এখনো অবশ। ডাক্তাররাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আদৌ তিনি সুস্থ হবেন কিনা। গত ২৫ জুন হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয় তাকে। এখন বাড়িতেই অবস্থান করছেন তিনি।
পারভেজের মা পারভিন বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলে গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসার চালাতো, সেই ছেলেটাই আজ পঙ্গু। চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছি। বাড়ি-ভিটা ছাড়া কিছু নেই। ছেলের বউ নাতনিকে নিয়ে চলে গেছে।’
জুলাই যোদ্ধা পারভেজ জানান, ‘চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সরকার থেকে পেয়েছি মাত্র ১ লাখ টাকা, সেটাও দুই মাস আগে। প্রশাসনের সহায়তা চাইতে গেলে স্থানীয় ইউএনও আমাকে অবহেলা করেছেন। পরে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে গেলে তিনি ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই বৈষম্য দূর করার জন্যই তো আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। আজ আমি নিজেই বৈষম্যের শিকার। যদি সেদিন মরে যেতাম, শহীদ হতাম, দেশের জন্য জীবন দিতাম। এখন এইভাবে বেঁচে থাকা কি বেঁচে থাকা? অবহেলা নিয়ে আর কতদিন বাঁচব?’
পারভেজের ছোট ভাই মারুফ মিয়া নবম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের আর্থিক দুরবস্থায় তার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। এ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন পারভেজ।
প্রতিবেশী হুমায়ুন ফরিদ বলেন, ‘পারভেজ গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসার চালাত। এখন সে পঙ্গু। সরকার থেকে যে অনুদান পেয়েছে, তার চেয়ে চারগুণ বেশি ঋণ হয়েছে। সরকারের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো।’
ফুলবাড়ীয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক আগে একবার এসেছিলেন পারভেজ। তখন তাকে কোনো সহায়তা করতে পারিনি।’