প্রবাসীবান্ধব দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম কুয়েত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লাখো শ্রমিক এই দেশটিতে বসবাস ও কর্মরত। তবে দীর্ঘদিন আলোচনার পর অবশেষে প্রবাসীদের জন্য নতুন ও কঠোর নিয়ম কার্যকর করতে চলেছে দেশটি। আগামী ডিসেম্বর থেকেই এসব নতুন বিধিনিষেধ, ফি বৃদ্ধি ও ভিসা-বাসস্থান- সংক্রান্ত নতুন শর্ত বলবৎ হবে। গালফ নিউজ ও কুয়েত টাইমসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
নতুন নীতি অনুযায়ী, দেশটিতে থাকার নিয়ম, ভিসা নবায়ন, নির্ভরশীল স্পনসরশিপ, অস্থায়ী ভিসা, গৃহশ্রমিক নিয়োগ, পুরোনো ফোন ডাম্পিংসহ বহু ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। নতুন কাঠামো চালু হলে প্রবাসীদের পরিবার নিয়ে থাকা, চাকরি বদল, কিংবা ছুটিতে দেশ ত্যাগ-ফিরে আসা- সব ক্ষেত্রেই বাড়বে ঝামেলা ও খরচ।
কুয়েতের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসব পরিবর্তন গত বছর প্রণীত নতুন বাসস্থান আইনের এক্সিকিউটিভ আইনাবলির অংশ। রোববার গেজেটে প্রকাশের মাধ্যমে তা চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
স্পনসরশিপে কঠোরতা: পরিবার আনতে বাড়তি বেতন ও ফি
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কুয়েতে বসবাসরত প্রবাসী যদি তার স্ত্রী ও সন্তানদের স্পনসর করতে চান, তবে তার মাসিক বেতন কমপক্ষে ৮০০ কুয়েতি দিনার হতে হবে।
আগে তুলনামূলক কম আয়েও পরিবার আনা যেত, কিন্তু নতুন বিধানে এটি উল্লেখযোগ্যভাবে কঠোর করা হয়েছে।
পরিবারের বাইরের নির্ভরশীল- যেমন বাবা-মা, ভাইবোনদের- স্পনসর করতে চাইলে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩০০ দিনার ফি দিতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে নির্ভরশীলদের আগমন কমানোর লক্ষ্যে সরকার এমনই কঠোর নীতি গ্রহণের কথা ভাবছিল, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
সব ধরনের ভিজিট ভিসায় একক ফি
যেকোনো ভিজিট ভিসা- ট্যুরিস্ট, পরিবার পরিদর্শন, কাজের প্রবেশ, অথবা বাসস্থান প্রবেশ-
সব শ্রেণির ভিসায় এখন থেকে একক ১০ দিনার ফি নির্ধারিত হয়েছে। এটি একবার নবায়নযোগ্য। তবে শর্ত সাপেক্ষে এসব ভিজিট ভিসা বাসস্থানে রূপান্তরিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
নবজাতকের ক্ষেত্রে বাসস্থান স্ট্যাম্পিংয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে। আগে নির্ধারিত সময়সীমা ছিল কম, এখন পিতা-মাতা ৪ মাস সময় পাবেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য।
নবায়ন ফি দ্বিগুণ
সরকারি চাকরিজীবী, বেসরকারি খাতের কর্মী, বিদেশি ছাত্র, ধর্মীয় পাদরি- এ ধরনের ক্যাটাগরির বাসস্থান নবায়নের ফি নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্বিগুণ করা হয়েছে। এখন থেকে নবায়ন ফি প্রতি বছর ২০ দিনার।
স্ব-স্পনসর্ড রেসিডেন্স (অৎঃরপষব ২৪) চালু করা হয়েছে, যার ফি প্রতি বছর ৫০০ দিনার, যা প্রবাসীদের জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল ক্যাটাগরির একটি।
বিদেশি বিনিয়োগকারী ও সম্পত্তি মালিকদের (অৎঃরপষব ১৯ ও ২১) জন্য প্রতি বছর থাকবে ৫০ দিনার ফি।
অস্থায়ী ভিসায় কঠোরতা
অস্থায়ী বাসস্থান (অৎঃরপষব ১৪) ফি শর্ত হিসেবে প্রতি মাসে ১০ দিনার দিতে হবে। গৃহশ্রমিকদের ক্ষেত্রে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দিনার।
যারা বাসস্থান বাতিল করে দেশে ফিরতে চান, তাদের ‘ইগ্রেস পিরিয়ড’ বা প্রস্থান- সময়সীমায় প্রতি মাসে ১০ দিনার ফি দিতে হবে।
কুয়েতের বাইরে ছয় মাসের বেশি থাকার প্রয়োজন হলে, প্রতি মাসে ৫ দিনার ফি ধার্য থাকবে।
গৃহশ্রমিক নিয়োগেও নতুন সীমা ও কোটা
নতুন নীতিতে গৃহশ্রমিক নিয়োগের ওপরও নতুন সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে- ৬ সদস্য বা কম সদস্যবিশিষ্ট পরিবার: সর্বোচ্চ ৩ জন গৃহশ্রমিক, ৬-৯ সদস্যবিশিষ্ট পরিবার: সর্বোচ্চ ৪ জন, ৯ জনের বেশি সদস্যবিশিষ্ট পরিবার: সর্বোচ্চ ৫ জন, গৃহশ্রমিকদের জন্য ফিও পুনর্র্নিধারণ করা হয়েছে।
নবায়ন ও রূপান্তরের কঠোর নিয়মাবলি
ভিসা নবায়ন ও ভিসা রূপান্তরের ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড আরোপ করা হয়েছে। বিশেষত নির্ভরশীলদের ক্ষেত্রে বাড়তি কাগজপত্র, আয়ের নির্দিষ্ট সীমা ও অন্যান্য শর্ত পূরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে প্রবাসী পরিবারগুলোকে ভবিষ্যতে আরো জটিলতা মোকাবিলা করতে হতে পারে।
নতুন আইন কেন? কুয়েত সরকারের ব্যাখ্যা
কুয়েত সরকার জানিয়েছে, নতুন অভিবাসন নীতি আসলে তিনটি কারণকে কেন্দ্র করে- অপ্রয়োজনীয় শ্রমঘন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দেশের নিরাপত্তা ও আইসিটি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং বহিরাগত চাপ কমানো ও শ্রমবাজারকে সুশৃঙ্খল রাখা।
বছরের শুরুতেই কুয়েতের আইনসভা ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, দেশের অভিবাসন নীতি সংস্কার হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিদেশি নাগরিকদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তিকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা ছিল অনেকদিন ধরেই।
বাংলাদেশি প্রবাসীদের প্রভাব: বাড়বে ঝামেলা ও ব্যয়
কুয়েতে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত। তাদের মধ্যে অধিকাংশ নিম্নআয়ের কাজে যুক্ত। নতুন নীতি কার্যকর হলে-
যা বাড়বে: পরিবার নিয়ে থাকতে গেলে আয়–মানদণ্ডের চাপ, গরিব-মধ্যবিত্ত প্রবাসীর পরিবার আনা কঠিন, ভিসা নবায়ন ও স্পনসরশিপের ব্যয় দ্বিগুণ, কর্ম পরিবর্তনে জটিলতা এবং অস্থায়ী ও দীর্ঘ-মেয়াদি ভিসায় অতিরিক্ত ফি।
যা কমবে: পরিবার ও নির্ভরশীলদের আগমন, অতিরিক্ত চাপ, ভিসা-ব্যবসা ও অবৈধ স্পনসরশিপ।
অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের মাসিক আয় ৮০০ দিনারের অনেক কম, ফলে তারা স্ত্রী-সন্তানকে স্পনসর করতে পারবেন না। এটি তাদের সামাজিক জীবনে চাপ ফেলবে।
ভিসা রূপান্তর ও নবায়নে নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নতুন টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ (সংশোধনী) ২০২৫- এ ইকেওয়াইসি ও আইএমইআই ডেটা সুরক্ষা জোরদার করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন তথ্য লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে নিম্নমানের কিংবা চোরাচালান- নির্ভর প্রবেশ বন্ধ করা হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
প্রবাসীদের জন্য কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে
কুয়েতের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে- ভিসা বা বাসস্থান নবায়নের আগে সব শর্ত ও কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হবে। সময়সীমা অতিক্রম করলে জরিমানা বহুগুণ বাড়তে পারে। কোনো পরিবারের সদস্যকে স্পনসর করার আগে নতুন আয়–মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। অস্থায়ী ভিসা নবায়ন বা রূপান্তরের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কঠোরতা বেশি থাকবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, কুয়েত দীর্ঘদিন ধরে তার অভিবাসন নীতি কঠোর করছে। লক্ষ্য হচ্ছে দেশের শ্রমবাজারকে পুনর্গঠন করা এবং স্থানীয় নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া। দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিশেষ করে যারা উচ্চ বেতনের চাকরিতে নেই।”
বিশ্লেষকদের মতে, কুয়েত এই নীতি গ্রহণের মাধ্যমে- বাজেটের চাপ কমাতে, জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতে এবং অবৈধ ভিসা-ব্যবসা বন্ধ করতে চাচ্ছে।
প্রবাসীদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে- ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ৫০ দিনারের ফি তেমন সমস্যা নয়; বরং এটি প্রক্রিয়া সহজ করবে। কিন্তু স্বল্পআয়ের শ্রমিকরা হতাশ, কারণ পরিবার স্পনসর করার মতো বেতন তাদের নেই।
একজন বাংলাদেশি শ্রমিক জানান- আমার বেতন ৩০০ দিনার। ছেলেকে আনার স্বপ্ন আর রইল না।
আরেকজন জানান- ভিসা নবায়নে দ্বিগুণ ফি হলে মাসিক সঞ্চয় কমে যাবে।
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ
নতুন নীতি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে- পরিবারের বিচ্ছিন্নতা, প্রবাসীদের আর্থিক চাপ, নিম্ন-আয়ের শ্রমিকদের চাকরি-সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা, ভিসা-রূপান্তর ও নবায়নে সময়-জট।
ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া কুয়েতের নতুন অভিবাসন নীতি প্রবাসীদের জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের শ্রমিকদের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে। কঠোর শর্ত, আয়ের সংজ্ঞা, ভিসা-নবায়ন ফি বৃদ্ধি, নির্ভরশীল স্পনসর সংকোচন- সব মিলিয়ে দেশে থাকা পরিবার ও কুয়েতে থাকা সদস্য- উভয়েই নতুন বাস্তবতায় অভিযোজনের চ্যালেঞ্জে পড়বে।