ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ২৫শে নভেম্বর মন্দিরের নিশান উড়িয়ে কাজ শেষ হওয়ার বিষয়টি ঘোষণাও করেছিলেন। অন্যদিকে, নতুন মসজিদের নির্মাণকাজ কিন্তু এখনো শুরু হয়নি।
প্রসঙ্গত, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে অযোধ্যা বিতর্ক নিয়ে রায় দেওয়ার সময় এই বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে মসজিদের জন্যও অযোধ্যাতেই জায়গা দেওয়া হোক।
এরপর ২০২০ সালে সরকার অযোধ্যা থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ধন্নীপুর গ্রামে পাঁচ একর জমি বরাদ্দ করে।
সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের তরফে 'ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন' নামে একটা ট্রাস্ট গঠন করে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হয়। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে কোনো কাজই এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি।
মসজিদ নির্মাণ না হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণও প্রকাশ্যে এসেছে। এই তালিকায় একদিকে যেমন অযোধ্যা থেকে মসজিদ তৈরির জন্য দেওয়া জমির দূরত্ব একটা কারণ বলে জানা গেছে, তেমনই ট্রাস্টের সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য এবং অর্থের অভাবের মতো বিষয়ও রয়েছে। ট্রাস্টের তৈরি নকশাও বাতিল করা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে 'ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন' নামক ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জুফর আহমেদ ফারুকি বলেন, "ট্রাস্টের কাছে অর্থ নেই, তাই কাজ শুরু হচ্ছে না"।
পাশাপাশি কোভিডের কারণেও বিলম্ব হয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তার কথায়, "জমি বরাদ্দ করার পরপরই কোভিড শুরু হয়। সেই কারণে সব কিছুতেই দেরিতে হয়েছে"।
"এরপর আমরা একটা নকশা চূড়ান্ত করি। কিন্তু সেই নকশা আমরা যখন প্রকাশ্যে আনি এবং ভারতজুড়ে বহু মানুষের সঙ্গে আলোচনা করি, তখন তা (নকশা) নিয়ে আপত্তি তোলা হয়"।
ছবির উৎস,Universal Images Group via Getty Images
বিবাদের সূত্রপাত
অযোধ্যা মামলা নিয়ে ১৯৬১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। তাদের তরফে দাবি করা হয় ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বাবরি মসজিদে নামাজ পড়া হতো। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর, হিন্দু পক্ষ সেখানে মূর্তি স্থাপন করে এবং তারপরই সেখানে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
এই বিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ষোলোশো শতাব্দীর বাবরি মসজিদ। হিন্দু পক্ষের দাবি ছিল, একসময় সেখানে হিন্দু মন্দির ছিল, মন্দির ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছিল ওই মসজিদ।
এরপর ১৯৯২ সালের ছয়ই ডিসেম্বর জনতার একাংশ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের সিদ্ধান্তে সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের দাবি গ্রহণ করে এবং বিতর্কিত দুই দশমিক ৭৭ একর জমির এক-তৃতীয়াংশ তাদের দেওয়া হয়। বাকি অংশটুকু হিন্দু পক্ষের কাছে যায়।
যদিও আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সব পক্ষই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। ভারতের শীর্ষ আদালত ২০১৯ সালে তার রায়ে পুরো জমি 'রামলালা বিরাজমান'-এর (রামচন্দ্রের বাল্যরূপ) হাতে তুলে দেয়।
পাশাপাশি, সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ নির্মাণ করার জন্য অযোধ্যাতেই পাঁচ একর জমি বিকল্প হিসেবে দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট তার আদেশে বলেছিল, "কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৯৩ সালে অধিগ্রহণ করা জমি থেকে পাঁচ একর সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়া হোক বা রাজ্য সরকার অযোধ্যার কোনো বিশিষ্ট জায়গায় এর জন্য জমি বরাদ্দ করুক"।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে যে জমি বরাদ্দ করা হয় সেটা অযোধ্যা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে সোহাওয়াল তহসিলের অন্তর্গত ধন্নীপুর গ্রামে অবস্থিত।
ছবির উৎস,Himanshu
বরাদ্দ জমি নিয়ে বক্তব্য
জমি বরাদ্দের প্রসঙ্গে রাইট টু ইনফর্মেশন (আরটিআই) অ্যাক্টিভিস্ট ওম প্রকাশ সিং বলেছেন, "অযোধ্যা নগরের মধ্যেই জমি বরাদ্দ করার নির্দেশ (আদালতের) দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে জমি আসলে দেওয়া হয় সেটা ২৫ কিলোমিটার দূরে ধন্নীপুরে অবস্থিত। এই নিয়ে আমি আরটিআইও দায়ের করেছি"।
অযোধ্যার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এত দূরে অবস্থিত মসজিদে সাধারণ মানুষ নামাজ পড়তে যাবেন না।
অযোধ্যার অঞ্জুমান মুহাফিজ মসজিদ এবং মকাবির কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ আজম কাদরি বলেছেন, "অযোধ্যার মানুষ ২৫ কিলোমিটার দূরে নামাজ পড়তে যাবেন না। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল যে জমি পুরসভার আওতার মধ্যে বা তার কাছাকাছি কোথাও দেওয়া হোক। কিন্তু সেই আদেশ উপেক্ষা করা হয়েছিল"।
তিনি আরও বলেন, "সরকার চাইলেই উন্নয়ন হয়। এর উদাহরণ হলো রাম মন্দির। সরকার চাইলে মসজিদও তৈরি হতে পারত"।

তবে এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান জুফর আহমেদ ফারুকি। তার কথায়, "সেই সময় সবাই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। তাই যে জমি দেওয়া হয়েছে সে নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ধন্নীপুরে মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে এবং মানুষ নামাজ পড়তেও যাবেন"।
স্থানীয় সাংবাদিক ইন্দু ভূষণ পান্ডের সঙ্গেও এই প্রসঙ্গে কথা বলেছিল বিবিসি। এই সাংবাদিক বলেছেন, "ধন্নীপুরের ওই এলাকায় ইতোমধ্যে এক ডজনেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের জমি অযোধ্যার মানুষকে দিয়েছিল, ধন্নীপুরের বাসিন্দাদের নয়"।
বাবরি মসজিদ বিবাদের সাবেক মামলাকারী ইকবাল আনসারির মতামত অবশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের রায় গোটা দেশ মেনে নিয়েছে, আমরাও মেনে নিয়েছি। আপনি যে দেশে বাস করেন, আপনাকে সেদেশের আইন মেনে চলতে হবে। আমাদের ধর্মও সে কথাই বলে"।
তিনি বলেন, তর্ক করার কোনো অর্থ নেই কারণ "যেখানে জমি পাওয়া গেছে, সেখানেও মসজিদ রয়েছে"।
ছবির উৎস,Zufar Farooqi
মসজিদের নকশা বাতিল
সালটা ২০২০। উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর-অযোধ্যা-লক্ষ্ণৌ মহাসড়কে রৌনাহি থানা থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে মসজিদের জন্য পাঁচ একর জমি বরাদ্দ করেছিল সরকার।
মসজিদের কাছেই একটা প্রাচীন দরগা রয়েছে, যা ঐতিহাসিক বলে দাবি করা হয়।
ট্রাস্ট মসজিদ এবং সংলগ্ন প্রাঙ্গণের জন্য একটা বিস্তারিত নকশা প্রস্তুত করেছিল। মসজিদ তৈরির কাজ কিন্তু তা সত্ত্বেও শুরু হয়নি এখনো।
অ্যাক্টিভিস্ট ওম প্রকাশ সিং এই প্রসঙ্গে তথ্য জানতে চেয়ে আরটিআই ফাইল করেছিলেন।
তার জবাবে অযোধ্যা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, "নকশা বাতিল করা হয়েছিল, কারণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দমকল বিভাগ, পিডব্লিউডি এবং বন বিভাগসহ ১৪-১৫টা বিভাগের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় এনওসি (নো অবজেকশন লেটার) জমা দেওয়া হয়নি"।
এই নিয়ে অবশ্য তরফে 'ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন' নামক ওই ট্রাস্টের নিজস্ব যুক্তিও রয়েছে। ট্রাস্টের তরফে জুফর আহমেদ ফারুকি বলেন, "আমরা একটা নতুন নকশা এবং একটা নতুনভাবে মসজিদ তৈরি করতে যাচ্ছিলাম। তাই কোনো বিভাগের কাছ থেকে কোনো এনওসি চাওয়া হয়নি"।
অযোধ্যা ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির ভাইস চেয়ারম্যান অনুরাগ জৈন এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ট্রাস্ট এখন মসজিদের জন্য নতুন গম্বুজের মতো নকশা তৈরি করেছে। ট্রাস্টের তরফে দাবি করা হয়েছে, এই নতুন নকশা ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে অযোধ্যা ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির কাছে জমা দিয়ে দেওয়া হবে।
জুফর ফারুকির কথায়, "মসজিদের নতুন নকশা প্রায় প্রস্তুত। এই মসজিদ ১৪০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে নির্মিত হবে এবং বাকি কমপ্লেক্সের উন্নয়ন পরে করা হবে"।
ছবির উৎস,Zufar Farooqi
'বোর্ড সদস্যরাও এখানে আসেন না'
মসজিদ তৈরিতে এই বিলম্ব নিয়ে ধন্নীপুরের মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তি রয়েছে। এই গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকার মানুষ এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে নারাজ।
ধন্নীপুর গ্রামে একটা মিষ্টির দোকান চালান মি. মাজিদ। তিনি বলেছেন, "শুরুর দিকে একটা আলোড়ন ছিল, কিন্তু এখন আর কেউ এই নিয়ে জানতেও চায় না। এখন আমরা শুনছি, সবকিছু বাতিল হয়ে গেছে। এমনকি বোর্ড সদস্যরাও কিন্তু এখানে আর আসেন না"।
যে রাস্তাটা গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে, সেই পথ দিয়ে যাতায়াত করা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। সেই সময় তারা জানিয়েছিলেন, ধন্নীপুর গ্রামে ইতোমধ্যে দু'টো মসজিদ রয়েছে।
স্থানীয়দের মধ্যে নেহাল আহমেদ নামে এক বাসিন্দা বলেন, "শুধু সংবাদ মাধ্যমের লোকজন এখানে আসেন, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা হয়রান। এখানকার দরগায় শুধু বৃহস্পতিবারই জিয়ারতের জন্য আসেন"।
রাজনৈতিক বিতর্ক
রাম মন্দির নির্মাণের পর মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বিলম্ব নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলো।
সমাজবাদী পার্টির অভিযোগ, শুরু থেকেই সরকারের মনোভাব বৈষম্যমূলক ছিল। দলের মুখপাত্র মহম্মদ আজম বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে মসজিদ অযোধ্যার একটা বিশিষ্ট জায়গায় তৈরি করা উচিত, কিন্তু সরকার তার জন্য ২০ কিলোমিটার দূরে জমি দিয়েছে। সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড গভর্নমেন্ট মেশিনারির মতো কাজ করছে, মসজিদ নির্মাণের কাজ ধীরগতিতে করছে"।
এ প্রসঙ্গে বিজেপির তরফে জানানো হয়েছে, এই পুরো বিষয়ের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিজেপির সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি কুনোয়ার বাসিত আলি বলেন, "মন্দির নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহ ছিল, কিন্তু মসজিদ নিয়ে উৎসাহ নেই। জনগণের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না এবং ওয়াকফ বোর্ড প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছে"।
ট্রাস্টের সদস্যরা অর্থাভাবের প্রসঙ্গও তুলেছেন। তাদের দাবি, মানুষ অনুদানের দেওয়া নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
ছবির উৎস,Zufar Farooqi
হাসপাতাল এবং কমিউনিটি কিচেনের পরিকল্পনা
ট্রাস্টের প্রথম বৈঠক হয়েছিল ২০২৪ সালে। মুম্বাইতে আয়োজিত সেই বৈঠকে দেড়শোরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে মসজিদের নকশা পরিবর্তন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কারণ নকশা নিয়ে সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গিয়েছিল।
জুফর ফারুকি বলেন, "প্রথম নকশা নিয়ে মানুষ আপত্তি জানিয়েছিলেন যে সেটা দেখতে কমপ্লেক্সের মতো। তাই গম্বুজের আকারে নকশা তৈরি করা হয়। সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা ধারণা ছিল যে পুরানো নকশাটা মসজিদের মতো ছিল না, তাই আমরা সেটা পরিবর্তন করেছি"।
মসজিদের নাম রাখা হয়েছে 'মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ', যা নবী মোহাম্মদের নাম। প্রথমে মসজিদ নির্মাণ করা হবে এবং পরে প্রস্তাবিত অন্যান্য প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
এডিএ-এর তরফে ওই নকশা অনুমোদিত হওয়ার পরে মসজিদের জন্য অনুদান সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে ট্রাস্ট। তাদের তরফে এটাও জানানো হয়েছে যে সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো আইনি বাধা বা চাপ নেই।
ট্রাস্ট ওই জমিতে হাসপাতাল ও কমিউনিটি কিচেন নির্মাণের পরিকল্পনাও করেছে। তবে এই মুহূর্তে সবই কাগজে-কলমে রয়েছে।