Image description

পাকিস্তান কয়েক দশকের মধ্যে তার সামরিক ও বিচারব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিশ্চিত করেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি দেশটির আইনসভায় অনুমোদিত ২৭তম সংবিধান সংশোধনী বিলে স্বাক্ষর করেছেন।

বিরোধী দলের প্রতিবাদ এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন ও বিচারকদের সমালোচনার মুখে এ সপ্তাহের শুরুতে আইনসভার উভয় কক্ষে অনুমোদিত হয় বিতর্কিত এ সংশোধনী। এটি পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনছে।

কিন্তু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, আর্টিকেল ২৪৩-এ ব্যাপক রদবদল আনা। পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে অনুচ্ছেদটিতে।

সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে দেশের শীর্ষ সামরিক নেতারা আজীবন দণ্ডমুক্তি পাচ্ছেন, সামরিক কমান্ড কাঠামো পুনর্গঠিত হচ্ছে এবং সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন যে এ বিতর্কিত সংস্কার পাকিস্তানের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন বন্দোবস্তের সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করতে এবং ভঙ্গুর বেসামরিক–সামরিক ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

আল-জাজিরা সংশোধনী ও এর বিতর্ক নিয়ে সেনাবাহিনীর মিডিয়া শাখার মন্তব্য চেয়েছে। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

নতুন কমান্ড কাঠামো

সংশোধিত আর্টিকেল ২৪৩ নতুন পদ ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস (সিডিএফ)’ প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘চিফ অব আর্মি স্টাফ (সিওএএস)’ বা সেনাপ্রধানই এ পদে অধিষ্ঠিত হবেন। ফলে সেনাপ্রধানকে পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ) এবং নৌবাহিনী (পিএন) উভয়ের ওপর নিযন্ত্রণক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে দেশের শীর্ষ সামরিক নেতারা আজীবন দণ্ডমুক্তি পাচ্ছেন, সামরিক কমান্ড কাঠামো পুনর্গঠিত হচ্ছে এবং সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

বর্তমান সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ২০২২ সালের নভেম্বরে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ভারতের সঙ্গে চার দিনের সংঘাত শেষ হওয়ার ১০ দিন পর গত ২০ মে পাঁচ তারকা র‌্যাঙ্কে উন্নীত হন।

আসিম মুনির পাকিস্তানের দ্বিতীয় সামরিক কর্মকর্তা; যিনি পাঁচ তারকা পদ অর্জন করেছেন। প্রথম ব্যক্তিটি ছিলেন ১৯৬০-এর দশকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো পাঁচ তারকা কর্মকর্তা পায়নি।

সংশোধনীর অধীন ‘চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি (সিজেসিএসসি)’–এর কার্যালয়ও এ মাসের শেষে বিলুপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে এ পদে চার তারকা জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা আছেন। ২৭ নভেম্বর অবসর নেবেন তিনি।

 
সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির (মাঝে), বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জাহীর আহমদ বাবর সিধু (বাঁয়ে) ও নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ (ডানে)। ১৯ মে, ২০২৫ছবি: পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তর/আল-জাজিরার সৌজন্যে

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো, পাকিস্তানের পারমাণবিক কমান্ড দেখভাল করার জন্য ‘কমান্ডার অব দ্য ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড (সিএনএসসি)’ পদের সৃষ্টি। এটি শুধু সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এ পদে চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেসের পরামর্শে তিন বছরের মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এ পদে নিয়োগ আরও তিন বছর বাড়ানোও যাবে।

সংশোধনী পাঁচ তারকা পদকে শুধু সম্মানজনক পদ থেকে সংবিধানস্বীকৃত পদে পরিণত করেছে, যা নানা সুবিধা পাবে। নতুন ব্যবস্থায় পাঁচ তারকা কর্মকর্তাদের আজীবন দণ্ডমুক্তি থাকবে এবং তাঁরা পদ, সুবিধা ও ইউনিফর্মে আজীবন থাকবেন।

ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে (পাঁচ তারকা কর্মকর্তাদের) আজীবন দণ্ডমুক্তি, আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগজনক।
—রিমা ওমর, পাকিস্তানের সংবিধান বিশেষজ্ঞ

একজন পাঁচ তারকা কর্মকর্তাকে সরানোর জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন হবে; যেখানে নির্বাচিত সরকারকে সরানো যেতে পারে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ রিমা ওমর বলেন, যেখানে সরকারের মুখপাত্ররা এ পদকে সম্মানজনক বলে উল্লেখ করেন; যা জাতীয় নায়কদের দেওয়া হয়; সংশোধনী তাঁদের শুধু সম্মান নয়, প্রকৃত ক্ষমতা প্রদানেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ওমর আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আজীবন দণ্ডমুক্তি, আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগজনক।’

এক সাবেক তিন তারকা জেনারেল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিবর্তনগুলো মূলত ‘সেনাপ্রধানের ক্ষমতা একচ্ছত্র করার উদ্দেশ্য’ বলে মনে হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ওই সংশোধনী অনুমোদন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান সরকার তিন বাহিনী নিয়ন্ত্রণের আইনেও সংশোধনী আনে। সংশোধিত আর্মি অ্যাক্ট অনুযায়ী, সেনাপ্রধানের মেয়াদ এখন তাঁর সিডিএফ হিসেবে নিয়োগের তারিখ থেকে আবার গণনা শুরু হবে।

সংশোধিত আর্টিকেল ২৪৩ নতুন পদ ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস (সিডিএফ)’ প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘চিফ অব আর্মি স্টাফ (সিওএএস)’ বা সেনাপ্রধানই এ পদে অধিষ্ঠিত হবেন। ফলে সেনাপ্রধানকে পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ) এবং নৌবাহিনী (পিএন) উভয়ের ওপর নিযন্ত্রণক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

গত বছর, আইনসভা বাহিনীর প্রধানদের মেয়াদ তিন থেকে পাঁচ বছর বাড়িয়েছিল। এর মানে মুনিরের মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলবে। সংশোধনীর অধীন নতুন ব্যবস্থায় এটি আরও বাড়বে। এ মাসের শেষে নতুন নিয়ম কার্যকর হলে, মুনির সিওএএস এবং সিডিএফ উভয় পদে কমপক্ষে ২০৩০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত থাকবেন।

সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য এবং ভারতের সঙ্গে সংঘাতের প্রভাব

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী; বিশেষ করে সেনাবাহিনী জাতীয় জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।

চারটি অভ্যুত্থান ও কয়েক দশকের প্রত্যক্ষ শাসনকালে, এমনকি ক্ষমতায় বেসামরিক সরকার থাকার সময়ও সেনাবাহিনীর প্রভাব ছিল। সেনাপ্রধানকে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

কোনো প্রধানমন্ত্রী পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি, আর চার সেনাপ্রধানের মধ্যে তিনজনের প্রত্যেকেই ৯ বছরের বেশি সময় শাসন করেছেন।

মুনিরের পূর্বসূরি জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বিদায়ী ভাষণে স্বীকার করেছিলেন যে, সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এ প্রথা ভাঙার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু ৩ বছর পর, বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠী ও বিরোধী দল দাবি করছে যে পরিস্থিতি সামান্যই বদলেছে এবং কেউ কেউ দাবি করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সেনাবাহিনীর প্রভাব আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।

সর্বশেষ ২৭তম সংবিধান সংশোধনী ও প্রতিরক্ষা খাতের পুনর্গঠন মে মাসে ভারতের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সংঘাতের ছয় মাস পর এসেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে যে এ সংস্কার কি সেই সংঘাতের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক আকিল শাহ বলেন, ভারতের সঙ্গে সংঘাত সেনাপ্রধানের জন্য ‘নজিরবিহীন ক্ষমতা সম্প্রসারণের’ সুযোগ তৈরি করেছে।

এ সংশোধনী ‘ভবিষ্যতের দিকনির্দেশমূলক প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন’। ভারতের সঙ্গে সংঘাত প্রমাণ করেছে যে পাকিস্তানের কমান্ড মডেল ১৯৭০-এর দশকের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে চলছে; যা ২১ শতকের ‘মাল্টি-ডোমেইন, হাইব্রিড যুদ্ধের’ জন্য উপযুক্ত নয়।
—আহমেদ সাঈদ, পাকিস্তানের সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল

‘এসব পরিবর্তন সশস্ত্র বাহিনীর অন্য দুটি শাখার ওপর সেনাবাহিনীর কার্যত ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতিকে ইউনিটি অব কমান্ডের ছদ্মবেশে যুদ্ধকালীন প্রয়োজনীয়তা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে’, আকিল শাহ বলেন আল-জাজিরাকে।

কিন্তু সংশোধনীর সমর্থকেরা এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। আইন ও বিচারবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আকিল মালিক বলেছেন, সংশোধনী পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ঘাটতি পূরণের জন্য।

‘প্রতিরক্ষা খাতে সংহতি ও সমন্বয় আরও উন্নত করতে সংবিধানগত কাঠামো দিয়েছে এ সংশোধনী। আমরা আমাদের জাতীয় নায়কদের দেওয়া সম্মানকেও (পাঁচ–তারকা পদ) সংবিধানগত স্বীকৃতি দিয়েছি এবং বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় নিশ্চিত করেছি’, আকিল বলেন।

সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল আহমেদ সাঈদও সংশোধনীকে ‘ভবিষ্যতের দিকনির্দেশমূলক প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সংঘাত প্রমাণ করেছে যে পাকিস্তানের কমান্ড মডেল ১৯৭০-এর দশকের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে চলছে; যা ২১ শতকের ‘মাল্টি-ডোমেইন, হাইব্রিড যুদ্ধের’ জন্য উপযুক্ত নয়।