দীর্ঘ অপেক্ষার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ও দালাল প্লাসের প্রতারিত আরও ১৪০ জন গ্রাহক তাঁদের অর্থ ফেরত পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল এই গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ব্যাংক ও পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা প্রায় ২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। প্রতারণা ঠেকাতে ভুক্তভোগীদের অনুকূলে পে-অর্ডার চেক ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে।
জানা যায়, ২০২০ সালে মহামারী করোনার সময় দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় অনলাইন কেনাকাটা। সেই সুযোগে ইভ্যালি, দালাল প্লাস, ইঅরেঞ্জ, কিউকম, আলেশা মার্টসহ বেশ কয়েটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কম দামে পণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে। পরে সেই পণ্য সরবরাহ না করে প্রতারণার আশ্রয় নেয় তারা।
কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে শীর্ষ ১২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা উল্টাপাল্টা ব্যবহারের তথ্য দেওয়া হয়। এ খাতের সন্দেহজনক ৫০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত তদন্তে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের তহবিল অপব্যবহারের তথ্য বেরিয়ে আসে। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রাহকদের পণ্য অর্ডারের বিপরীতে ১২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তহবিল সংগ্রহ করে ১০ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়, যা এই ১২ প্রতিষ্ঠানের মোট তহবিলের ৬৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ তথা ৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা পণ্য সরবরাহের পরিবর্তে অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংক ও এমএফএস থেকে ৬১০ কোটি বা ৬ শতাংশ টাকা নগদে উত্তোলন করে ব্যবহার করা হয়।
এদিকে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর ২০২১ সালের জুনে ই-কমার্সের সঙ্গে সব ব্যাংক, মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডর (পিএসপি) এবং পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরদের (পিএসও) লেনদেনের বিষয়ে নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ইস্যুকৃত ভাউচারের বিপরীতে পণ্য ক্রয় বা সেবা গ্রহণ না করা পর্যন্ত অর্থ ছাড় করা যাবে না। তখন প্রতারিত অনেক গ্রাহকের টাকা সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে যায় এবং অনেকেই আর পণ্য বা অর্থ ফেরত পাননি।
সরকার এসব অর্থ ফেরতের বিষয় তদারকি করতে সেন্ট্রাল ডিজিটাল কমার্স সেল (সিডিসিসি) গঠন করে। ওই সেলের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভুত্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তির কাজ করছে। এ দফায় ইভ্যালি ও দালাল প্লাসের ১৪০ জন গ্রাহকের ১ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩০ টাকা ফেরতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইভ্যালির গ্রাহক রয়েছেন ১২১ জন। তাঁদের জড়িত অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। তবে এসব অর্থ ফেরতের ক্ষেত্রে প্রতারণা ঠেকাতে ভুক্তভোগীদের সরবরাহকৃত অ্যাকাউন্টগুলো যাচাই-বাছাই ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিডিসিসি। গত এপ্রিল ও আগস্ট মাসে দুই দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ওই মতামত নেওয়া হয়।
সিডিসিসির চিঠির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের মতামতে জানায়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ইএফটি বা এনপিএসবির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের সঠিকতা যাচাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি
প্রক্রিয়া। তাই গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট-পেয়ি চেক বা পে-অর্ডার ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে নিরাপদ ও দ্রুততর হবে বলে পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ এই প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি চেক বা পে-অর্ডার নগদায়ন করতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন মতামতের ভিত্তিতে গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ইভ্যালি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক যাচাই-বাছাইকৃত তালিকা অনুযায়ী গ্রাহকদের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর অনুযায়ী পে-অর্ডার ইস্যু করে গ্রাহককে অর্থ ফেরত প্রদান করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা চাই গ্রাহকের কষ্টার্জিত অর্থ যেন সঠিকভাবে ও দ্রুত তাঁদের হাতে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক যে নিরাপদ পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে, সেটিই অনুসরণ করে রিফান্ড সম্পন্ন করার জন্য তাদের বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩৮৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে ই-কমার্স কোম্পানি কিউকম। এ ছাড়া আলেশা মার্ট প্রায় ৪১ কোটি, দালাল প্লাস প্রায় ২৩ কোটি এবং ইভ্যালি ২১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে।