নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির জয়ের খবর কয়েক হাজার মাইল দূরে ভারতের মুম্বাই ও দিল্লিতেও ধাক্কা দিয়েছে।
একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যখন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের মেয়র নির্বাচিত হন, তখন ভারতের রাজনীতিবিদদের মধ্যে ও সংবাদমাধ্যমে সেটি উদ্যাপনের কারণ হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
জোহরান মামদানি শুধু ভারতীয় নন; গুজরাটি বংশোদ্ভূতও, যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পরিণামগত পার্থক্য রয়েছে। জোহরান মামদানি একজন মুসলিম এবং ভারতের শাসক হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির কঠোর সমালোচক।
জোহরান মামদানির জয়ের পর ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপগুলোয় দেখা গেছে, ৩৪ বছর বয়সী এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট ও নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলি সদস্য তাঁর বিজয় ভাষণে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্ধৃতি দিচ্ছেন।
কিছু আন্তর্জাতিক শহরের রং পরিবর্তিত হচ্ছে। যদি কেউ মুম্বাইতে খান বসাতে চান, তা সহ্য করা হবে না!
‘ইতিহাসে খুব কম সময়ে এমন এক মুহূর্ত আসে, যখন আমরা পুরোনো থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে যাই। এটি তখনই ঘটে, যখন একটি যুগের শেষ হয় ও দীর্ঘদিন দমন করা জাতির আত্মা কণ্ঠ পায়’, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার প্রারম্ভে নেহরুর বিখ্যাত ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন জোহরান মামদানি।
‘আজ রাতে, নিউইয়র্ক ঠিক সেটাই করেছে’, আরও বলেন জোহরান মামদানি। বিজয় ভাষণ শেষে হাত নেড়ে সমর্থকদের অভিবাদন জানান তিনি। এ সময় স্ত্রী সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রমা দুওয়াজিকে মঞ্চে ডেকে নেন তিনি। ঠিক তখনই আবহ সংগীত হিসেবে বেজে ওঠে বলিউডের ২০০৪ সালের জনপ্রিয় ‘ধুম মাচালে’ গানটি। একই সময় মঞ্চে আসেন জোহরান মামদানির পাঞ্জাবি মা মীরা নায়ার ও গুজরাটি বাবা মাহমুদ মামদানি।
বিজেপি বনাম মামদানি
জোহরান মামদানি তাঁর ভারতীয় পরিচয় কখনো লুকাননি। তিনি প্রায়ই প্রচার ভিডিওতে ভারতীয় পোশাক পরে উপস্থিত হন এবং একবার আঙুল দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার ছবি প্রকাশিত হলে উগ্র দক্ষিণপন্থী মার্কিন সমালোচকদের কাছ থেকে বর্ণবাদী মন্তব্যের মুখোমুখি হন।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারতের শাসক বিজেপির অনেক নেতা জোহরান মামদানির বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় অস্বাভাবিকভাবে নীরব রয়েছেন।
অনেকে এখনো প্রধানমন্ত্রী মোদির অভিনন্দন সূচক টুইটের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু কয়েকজন বিজেপি নেতা তাঁদের কণ্ঠ আটকে রাখতে পারেননি; বিশেষ করে মুম্বাইয়ের বিজেপি প্রধান অমিত সাতম।
সাতম সতর্ক করে বলেন, ‘কিছু আন্তর্জাতিক শহরের রং পরিবর্তিত হচ্ছে।’ কিছু মেয়রের পদবির নাম আংশিকভাবে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘যদি কেউ মুম্বাইতে খান বসাতে চান, তা সহ্য করা হবে না!’ তাঁর এ বক্তব্য দৃশ্যত মুসলিমবিরোধী ইঙ্গিত বহন করে।
জোহরান মামদানি শুধু ভারতীয় নন; গুজরাটি বংশোদ্ভূতও, যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পরিণামগত পার্থক্য রয়েছে। জোহরান একজন মুসলিম এবং ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসক বিজেপির কঠোর সমালোচক।
এর আগে বিজেপির এক সংসদ সদস্য রেখা শর্মা মঙ্গলবার নিউইয়র্কে প্রবাসী ভারতীয়দের জোহরান মামদানির বিরুদ্ধে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলেন।
‘ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা, ভোট দিতে গেলে দুবার ভাবুন। মি. মামদানিকে একজন ভারতীয় মা ভারতের শুভাকাঙ্ক্ষী বানাননি’, বলেন রেখা শর্মা।
জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির ছয় লাখ মানুষের ব্যাপক সমর্থন পান; যদিও যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো তাঁর নিন্দা জানায়।
‘ভারতের বাস্তবতার প্রতিফলন’
হাজার হাজার ভারতীয় মুসলিম জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক বিজয় উদ্যাপন করেছেন। অনেকের কাছে এটি খুবই প্রতীকী ও মিশ্র অনুভূতির মুহূর্ত।
যেখানে ভারতীয় মুসলিমরা নিজ দেশে ক্রমশ তীব্রতর হওয়া বৈষম্যের শিকার, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচিত হলেন।
ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক রানা আইয়ুব গত বুধবার জোহরান মামদানির বিজয়কে ‘ভারতের সামনে একটি আয়না, যা হারানো প্রতিশ্রুতি ও বিদ্যমান সম্ভাবনা উভয়কে প্রতিফলিত করে’ বলে বর্ণনা করেন।
‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও ২২০ মিলিয়নেরও (২২ কোটি) বেশি মুসলিমের দেশ ভারতে সংসদের ক্ষমতাসীন জোটে একজন মুসলিম প্রতিনিধিও নেই’, বলেন রানা আইয়ুব। ‘জোহরান মামদানির বিজয় এবং ভার্জিনিয়ায় আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম ঘাজালা হাশমির জয় উভয়ই “গৌরব ও যন্ত্রণার” অনুভূতি জাগায়।’
‘গৌরব অনুভব হয় যখন ঐতিহ্য–সংস্কৃতি ভাগ করা মানুষেরা দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী অবস্থানে আসেন। যন্ত্রণা অনুভব হয় যখন আমরা বুঝি যে ভারতীয় রাজনীতিতে এমন সম্ভাবনা দূর হয়ে গেছে।’
‘একসময় প্রজাতন্ত্র গঠনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখা ভারতের মুসলিমরা এখন প্রধানত স্মৃতি ও প্রবাসীদের অর্জনে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পান।’
মামদানির বিজয়ের প্রাসঙ্গিকতা
ভারতের অনেক মানুষের কাছে জোহরান মামদানির বিজয়ের আরেকটি তাৎপর্য হলো তাঁর গুজরাটি বংশ। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলিমদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ঘটে, হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। তখন মোদি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
জোহরান মামদানি কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কে মোদির সফর আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। চলতি বছর মে মাসে এক প্রচারাভিযানে তিনি বলেছিলেন, ‘মোদি গুজরাটে মুসলিমদের গণহত্যা সংঘটনে সহায়তা করেছিলেন।’ তাঁর এ বক্তব্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ঝড় তোলে। মোদিকে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যাপকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
‘এ মানুষটিকে আমরা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো দেখি—তিনি একজন যুদ্ধাপরাধী’, জোহরান মামদানি আরও বলেন।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও ২২০ মিলিয়নেরও বেশি মুসলিমের দেশ ভারতের সংসদে ক্ষমতাসীন জোটে একজন মুসলিম প্রতিনিধিও নেই। জোহরান মামদানির বিজয় এবং ভার্জিনিয়ায় আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম ঘাজালা হাশমির জয় উভয়ই গৌরব ও যন্ত্রণার অনুভূতি জাগায়
এ মন্তব্যের জবাবে বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সঞ্জু ভার্মা জোহরানকে ‘অত্যন্ত মিথ্যাবাদী’, ‘অপমানজনক’ ও ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
গত জুনে সাবেক অভিনেত্রী ও বিজেপির সংসদ সদস্য কঙ্গনা রানাউত দাবি করেন, জোহরান মামদানিকে ‘ভারতীয়ের চেয়ে পাকিস্তানি বেশি মনে হয়…তাঁর হিন্দু পরিচয় কোথায় গেছে এবং এখন তিনি হিন্দুধর্মকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রস্তুত, বাহ্!!’
তবে এটি স্বাভাবিক যে মোদি এখনো জোহরান মামদানিকে তাঁর বিজয় উপলক্ষে অভিনন্দন জানাননি।
বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া
বিপরীতে, কিছু বিরোধী ভারতীয় রাজনীতিবিদ জোহরান মামদানির নির্বাচনী বিজয়কে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন।
কংগ্রেস নেত্রী ও জওহরলাল নেহরুর প্রপৌত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জোহরান মামদানিকে তাঁর বিজয় ভাষণে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করার জন্য প্রশংসা করেন।
‘নেহরুর নিজ দেশে আমরা দেখি, তাঁকে নিয়মিত অপমান করা হচ্ছে’, মন্তব্য করেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। নেহরু বিজেপির কাছে একজন অপ্রিয় নেতা।
হাজার হাজার ভারতীয় মুসলিম জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক বিজয় উদ্যাপন করেছেন। অনেকের কাছে এটি খুবই প্রতীকী ও মিশ্র অনুভূতির মুহূর্ত। যেখানে ভারতীয় মুসলিমরা নিজ দেশে ক্রমশ তীব্রতর হওয়া বৈষম্যের শিকার, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচিত হলেন।
‘অসাধারণ বিজয়’
কংগ্রেস নেতা ও বিশিষ্ট লেখক শশী থারুর জোহরান মামদানির নেহরুর উদ্ধৃতি ব্যবহারকে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে বর্ণনা করেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারকে তাঁর ছেলের ‘অসাধারণ বিজয়ের’ জন্যও আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
ভারতের জনপ্রিয় কমেডিয়ান কুণাল কামরা মন্তব্য করেন, ‘জোহরান মামদানি ভারতকে আদানি ও আম্বানির চেয়ে বেশি গর্বিত করছেন।’
২০২৩ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে জোহরান মামদানিকে উমর খালিদের কথা বলতে শোনা যায়। ভারতীয় মুসলিম ইতিহাসবিদ ও অধিকারকর্মী খালিদ মুসলিমদের ব্যাপারে বৈষম্যমূলক ও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় কারাগারে ছিলেন। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিনা অভিযোগে কারাগারেই আছেন তিনি।