সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।

‘খুঁজে বের করা, আটক, হত্যা’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রোববার থেকে বুধবারের মধ্যে ৬২ হাজারের বেশি মানুষ এল-ফাশের থেকে পালিয়েছে। আগস্টের শেষ নাগাদ করা হিসাব অনুযায়ী, এল-ফাশেরে ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল।
শুক্রবার চিকিৎসা সহায়তাবিষয়ক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) একটি বিবৃতি দিয়েছে। ঘটনাস্থলে কাজ করা সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, গত পাঁচ দিনে মাত্র ৫ হাজারের কিছু বেশি মানুষ তাবিলায় পৌঁছাতে পেরেছেন।
এমএসএফের জরুরি বিভাগের প্রধান মিশেল অলিভিয়ে লাসাহিত বলেছেন, চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের কাছে তাঁরা শুনেছেন যে দারফুর থেকে পালিয়ে আসার সময় সাধারণ নাগরিকদের হন্যে হয়ে খোঁজা, আটক করা ও হত্যা করা হচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান।
এমএসএফ বলেছে, গত ২৭ অক্টোবর তাবিলায় আসা ৭০ শিশুর মধ্যে পাঁচ বছরের কমবয়সী সব শিশু অপুষ্টিতে ভুগছিল। তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ ভুগছিল তীব্র মাত্রার অপুষ্টিতে।
আরএসএফের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা সহায়তা সংস্থাগুলোকে বলেছেন, আরএসএফ যোদ্ধারা মানুষকে লিঙ্গ, বয়স বা জাতিগত পরিচয় অনুযায়ী আলাদা করছিলেন। অনেককে মুক্তিপণ চাইতে আটকে রাখা হয়েছিল। মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি সুদানি পাউন্ড (৮ হাজার থেকে প্রায় ৫০ হাজার ডলার)।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তি বলেছেন, আরএসএফের যোদ্ধারা কয়েকজন বন্দীকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করেছেন।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক সহায়তা দিয়ে থাকে। তারাও দারফুর থেকে পালিয়ে আসা মানুষের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো বর্ণনা করেছে। তবে এসব মানুষের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
২৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, ২০০ পুরুষ, নারী ও শিশুর একটি দল তাবিলায় পালিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। তাদের বিভিন্ন চেকপয়েন্টে থামানো হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারজন মুক্তিপণ পরিশোধ করায় প্রাণে বেঁচে গেছে।
এ ব্যক্তি আরও বলেন, ‘বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা শিশু, বয়স্ক মানুষ ও নারীদেরও হত্যা করেছেন। এ দৃশ্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়। চোখের সামনে একের পর এক মানুষকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যেতে দেখা সহ্য করার মতো নয়।’
২৬ বছর বয়সী এক নারী বলেন, তাঁর স্বামী শুধু তাঁর ও সন্তানদের মুক্তিপণের টাকা দিতে পেরেছেন। পরে তাঁদের চোখের সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়।
১৯ বছর বয়সী এক তরুণী বলেন, আরএসএফের সেনারা তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। এর আগে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি কুমারী কি না।
ইউএনএফপিএ আরও নিশ্চিত করেছে, ২৯ অক্টোবর এল-ফাশেরের প্রসূতি হাসপাতালে কমপক্ষে ৪৬০ মানুষ আরএসএফ যোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। তবে নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, তাদের মধ্যে রোগী, দর্শনার্থী, বাস্তুচ্যুত মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও আছে।
করদোফানে আরও হত্যাকাণ্ড
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, পার্শ্ববর্তী উত্তর করদোফানে গত সপ্তাহে আরএসএফের দখল করা বারা এলাকা থেকে ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, উত্তর করদোফান সম্ভবত আরএসএফ ও সুদানি সেনাদের পরবর্তী লড়াইয়ের ক্ষেত্র হবে। কারণ, রাজ্যটির রাজধানী এল-ওবেইদ এখনো সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক গত শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আরএসএফের বারা শহর দখলের প্রেক্ষাপটে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আসছে। এর মধ্যে পাঁচজন রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগও রয়েছে। আমাদের মানবাধিকারবিষয়ক সহকর্মীরাও যৌন সহিংসতা নিয়ে আশঙ্কাজনক খবর পেয়েছেন।’
সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্কের মুখপাত্র মোহাম্মদ এলশেখ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার থেকে আল–জাজিরাকে বলেন, বারা এলাকা থেকে পালানো মানুষের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি বলেন, ‘বারা শহর থেকে এল-ওবেইদ শহরে যাওয়ার পথটা দীর্ঘ। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে খুবই বিপজ্জনক রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। আমরা এখানে মরুভূমি, দিনে প্রচণ্ড উষ্ণতা আর রাতে খুব ঠান্ডা পরিস্থিতির কথা বলছি।’
বারা শহরটি সুদানি সেনা ও আরএসএফের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আধাসামরিক গোষ্ঠীটি আশপাশের এলাকায়ও অগ্রসর হচ্ছে।
গত জুলাই মাসে আরএসএফ যোদ্ধারা উত্তর করদোফানের গ্রামগুলোতে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ প্রায় ৩০০ জন নিহত হন।