এই ছবিটি ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছবিগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত। দেখা যায়, ক্ষুধার্ত এক শিশু মাটিতে পড়ে আছে— এতটাই দুর্বল যে নড়াচড়া করতেও অক্ষম। অল্প দূরে বসে আছে একটি শকুন। অপেক্ষায় আছে কখন শিশুটি মারা যাবে।
১৯৯৩ সালে সুদানের এই ভয়াবহ দৃশ্য ধরা পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকান আলোকচিত্রী কেভিন কার্টারের ক্যামেরায়। ছবিটির নাম ছিল ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’। যদিও পরে জানা যায়, ছবির শিশুটি আসলে এক কন্যা নয়, একটি ছেলে।
ছবিটি প্রকাশের পর সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় সুদানের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি কার্টারের জীবনে নিয়ে আসে প্রবল বিতর্ক, নিন্দা আর এক ভয়ংকর মানসিক সংকট। যার শেষ হয় এক মর্মান্তিক পরিণতি মৃত্যুতে।
যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের সাক্ষী কেভিন কার্টার ‘ব্যাং ব্যাং ক্লাব’ নামে পরিচিত একটি আলোকচিত্রী দলের সদস্য, যারা আফ্রিকার নানা প্রান্তে সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধের ছবি তুলতেন। ১৯৯৩ সালে তিনি সুদানে যান সেই দেশের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের দৃশ্য ধারণ করতে।
সুদানের আয়োদ নামের এক গ্রামে পৌঁছে তিনি খাদ্যবিতরণ কেন্দ্রের পাশে ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি তুলছিলেন। পরে সেখান থেকে কিন্তু কিছুটা দূরে যেতেই তিনি দেখেন একটি শিশু খাদ্যকেন্দ্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শিশুটি হঠাৎ মাটিতে পড়ে যায়, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে। ঠিক তখনই একটি শকুন এসে তার পাশে বসে, যেন অপেক্ষা করছে শিশুটির শেষ নিঃশ্বাসের।
কার্টার সেখানে সতর্কভাবে ২০ মিনিট অপেক্ষা করেন, যাতে শকুনটি শিশুর কাছাকাছি আসে। এরপর তিনি নিখুঁতভাবে ছবিটা তোলেন। ছবি তোলার পর তিনি শকুনটিকে তাড়িয়ে দেন।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছবিটি প্রকাশিত হয়। এক বছর পর ছবিটি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। কিন্তু ছবির সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নৈতিক বিতর্কের ঝড়।
বিতর্ক আর নিন্দা ছবি প্রকাশের পর শত শত পাঠক পত্রিকা অফিসে জানতে চান— শিশুটি কি বেঁচে ছিল?
পত্রিকাটি পরের দিন একটি সম্পাদকীয় নোটে জানায়, ‘ফটোগ্রাফার জানিয়েছেন, শিশুটি পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। তবে সে খাদ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে পেরেছিল কিনা, তা জানা যায়নি।’
তবু সমালোচনা থামেনি। অনেকে জানতে চান— কার্টার কেন শিশুটিকে সাহায্য করেননি? আমেরিকার সেন্ট পিটার্সবার্গ টাইমস লিখেছিল, ‘যে মানুষ তার ক্যামেরার লেন্স ঠিক করতে ব্যস্ত, সে-ই যেন আরেকটি শকুন— দৃশ্যের আরেক শিকারি।’
শিশুটিকে সাহায্য না করার কথা জানতে পেরে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। যদিও কার্টার এ ঘটনার জন্য বহুবার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জানান, রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় তাদেরকে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের কাছাকাছি না যেতে বলা হয়েছিল।
সাফল্যের আড়ালের অন্ধকার তার এই ছবি বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়। আর ফটোসাংবাদিক হিসেবেও বিশ্ব স্বীকৃতি পান। ১৯৯৪ সালে অর্জন করেন পুলিৎজার পুরস্কার। তবে পুরস্কার লাভের কয়েক মাস পরেই তার জীবনে গভীর বিষণ্নতা নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যার আগে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি সত্যিই দুঃখিত। জীবনের যন্ত্রণা এতটাই প্রবল যে আনন্দ বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। এখনো সেই দৃশ্যগুলো আমার চোখে ভাসে— হত্যা, লাশ, ক্ষুধার্ত শিশু, উন্মত্ত মানুষ…।’
তার সহকর্মী জোয়াও সিলভা জানান, সুদান থেকে ফিরে আসার পর থেকেই কার্টার গভীরভাবে হতাশায় ভুগছিলেন।
তার বন্ধু জুডিথ ম্যাটলিফ বলেন, ‘মানুষ বারবার বলত ওর উচিত ছিল শিশুটিকে সাহায্য করা। এই কথাই ওকে তাড়িয়ে বেড়াত।’
কার্টার ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, একবার গাড়ি দুর্ঘটনার পর তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এরপর তার প্রেমিকাও তাকে ছেড়ে চলে যান।
বন্ধুরা বলেন, শেষদিকে তিনি বিছানা থেকে উঠতেও পারতেন না, কাজেও ভুল করতেন বারবার।
একবার মোজাম্বিকে কাজ শেষে ফিরে এসে বুঝতে পারেন— পুরো ফিল্ম রোলটাই বিমানে ফেলে এসেছেন।
কার্টেল তখন তার বন্ধু রিদওয়ান ভ্যালিকে বলেন, ‘এবার শেষ। আমি আর পারছি না। বাঁচতে ইচ্ছে করে না।’
মৃত্যুর পর টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত চিঠিতে কার্টারের বোন প্যাট্রিসিয়া গার্ড র্যান্ডবার্গ লেখেন, ‘বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যায়ের চোখ খুলে দেওয়ার যে মিশনে সে নেমেছিল, সেই যন্ত্রণাই একসময় তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। তার পুলিৎজার পুরস্কারই প্রমাণ করে তার কাজ বৃথা যায়নি।
কি হয়েছিল সেই শিশুটির কার্টারের মৃত্যুর বহু বছর পরও মানুষের প্রশ্ন ছিল— ছবির শিশুটি কি বেঁচে আছে? তার উত্তর পাওয়া যায় ২০১১ সালে।
এক সাংবাদিক সেই শিশুর পরিবারকে খুঁজে পান। জানা যায়, শিশুটি মেয়ে নয় ছেলে। যার নাম কং নিয়ং। সে খাদ্যকেন্দ্রে পৌঁছেছিল এবং দুর্ভিক্ষ থেকেও বেঁচে গিয়েছিল। তবে ২০০৭ সালে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।