সমুদ্রে প্রায় ২০ লাখ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার প্রজাতি সম্পর্কে এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। বাকিরা তবে কোথায় লুকিয়ে? এ প্রশ্নের উত্তর সমুদ্রের ওই সব অংশে লুকিয়ে আছে, যেখানে এখনো কোনো মানুষের পা পড়েনি। মানুষ মহাবিশ্ব সম্পর্ক যতটা জানে, সমুদ্র সম্পর্ক ততটা জানে না। শুনতে অবাক লাগলেও ঠিক, সমুদ্রের তলদেশের চেয়ে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মানচিত্র সম্পর্কে আমরা বেশি জানি। বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির তলদেশের রহস্যে ঘেরা স্থানগুলো নিয়ে আজকের শীর্ষ ১০–এর আয়োজন।
রস সি আইস শেলফ
বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইস শেলফটি রস সাগরে (অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ মহাসাগরে একটি গভীর উপসাগর) অবস্থিত। সাহসী গবেষকদের অল্প কয়েকটি দল ওই শেলফের কয়েক শ মিটার খনন করেছেন ও এর তলদেশে অচেনা প্রজাতির কিছু প্রাণের সন্ধান পেয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়ির মতো খোলসযুক্ত প্রাণীও রয়েছে। সেগুলো কীভাবে ওই আইস শেলফের তলদেশে গেল এবং প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেই-বা কীভাবে জীবিত আছে, তা কেউ জানেন না।
রহস্যময় উপায়ে এই প্রাণীগুলোর টিকে থাকার বিষয়টি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপরও যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের আইস শেলফগুলোর পরিবেশ বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপার মতো এবং এ থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, পৃথিবীর বাইরেও এ ধরনের শীতল পরিবেশে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে।
গ্যাকল রিজ
গ্রিনল্যান্ড ও সাইবেরিয়ার মধ্যে অবস্থিত গ্যাকল রিজ বা গ্যাকল শৈলশিরা। এটি মহাসাগরের ভেতর বিশ্বের সবচেয়ে গভীর শৈলশিরা। শৈলশিরাটি সমুদ্রের পানির তিন মাইলের বেশি গভীরে অবস্থিত। গ্যাকল শৈলশিরার বেশির ভাগ অঞ্চলই এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। ২০০৩ সালে বিজ্ঞানীরা এ শৈলশিরায় আর্কটিক অঞ্চলের প্রথম উষ্ণ প্রস্রবণ খুঁজে পান। সাধারণত সামুদ্রিক প্রাণীরা উষ্ণ প্রস্রবণ ঘিরে বসবাস করে। মহাসাগরের আশপাশের অঞ্চলের তুলনায় উষ্ণ প্রস্রবণে সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাসের সংখ্যা এক লাখ গুণ বেশি। সমুদ্রের উষ্ণ প্রস্রবণ ঘিরে যত প্রজাতির প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
ক্যাসকাডিয়া প্রান্তের ‘শ্যাম্পেইন’ ক্ষরণ
অনেক জায়গায় সমুদ্রের তলদেশের ফাটল দিয়ে মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসে। মিথেনের এমন ক্ষরণকে ‘কোল্ড সিপ’ বলে। তবে নাম ‘কোল্ড সিপ’ হলেও সেখানকার পানি আশপাশের সমুদ্রের পানির তুলনায় উষ্ণ হয়। এসব অঞ্চলে প্রাণবৈচিত্র্যও তাই অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের ক্যাসকাডিয়া প্রান্তে সম্প্রতি এমন প্রায় পাঁচ শত ‘শ্যাম্পেইন’ ক্ষরণ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো দিয়ে শ্যাম্পেইনের বুদ্বুদ্ ওঠার মতো করে মিথেন গ্যাস উঠে আসে। বেরিয়ে আসতে থাকা এ গ্যাস কোথায় তৈরি হয়, তা এখনো রহস্যের আড়ালেই রয়ে গেছে।
গ্রিনল্যান্ডের প্রবালপ্রাচীর
২০১২ সাল, গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে কেপ ডেসোলেশন (একটি অন্তরীপ) থেকে ৯০০ মিটার নিচে পানির নমুনা সংগ্রহ করার সময় গবেষকেরা প্রবালপ্রাচীরের মুখোমুখি হন। তাঁরা নমুনা সংগ্রহের জন্য যখন যন্ত্র নিচে নামাচ্ছিলেন, তখন পানির তলদেশে থাকা কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেটি ভেঙে যায়। প্রথমবারের মতো তাঁরা বুঝতে পারেন যে পানির নিচেও কোনো প্রাচীর আছে। যন্ত্র ভেঙে যাওয়ায় প্রাথমিকভাবে হতাশ হলেও তা উচ্ছ্বাসে পরিণত হতে সময় লাগেনি, যখন বুঝতে পারেন, আসলে পানির নিচে কী আবিষ্কার করেছেন তাঁরা।
গ্রিনল্যান্ডের বরফ শীতল পানির নিচের এ প্রবালপ্রাচীর সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানা যায়নি। নরওয়েতে এমন একটি প্রবালপ্রাচীর আছে, যার বয়স আট হাজার বছর। প্রবালের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যের আলো অত্যন্ত জরুরি। এ কারণে সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলরাশিতে প্রবাল দেখতে পাওয়া যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, গ্রিনল্যান্ডের জলরাশি যেখানে পানির তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেখানেও প্রবাল বেঁচে থাকতে সক্ষম। এ ধরনের প্রাচীর এবং সেখানে কী কী প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে, সেই রহস্য এখনো উন্মোচনের অপেক্ষায়।
টোঙ্গা ট্রেঞ্চের হরাইজন ডিপ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ বা মারিয়ানা খাতের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় গভীর খাত টোঙ্গা ট্রেঞ্চ; যেখানে জেলিফিশ ও ‘সামুদ্রিক শসা’র মতো অনেক প্রাণীর বাস। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত এ খাতের কোথাও কোথাও ১০ কিলোমিটারের বেশি গভীর।
ফন ড্যাম ভেন্ট ফিল্ড
‘ফন ড্যাম ভেন্ট ফিল্ড’ উষ্ণ প্রস্রবণগুলো ম্যাগনেশিয়াম সিলিকেট (বেবি পাউডারে পাওয়া যায়) থেকে তৈরি। ২০১০ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। এটি ক্যারিবীয় সাগরের মাঝখানে একটি শৈলশিরার অংশ। এ শৈলশিরার ৭৫ শতাংশই এখনো রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছে।
কার্টার সি-মাউন্ট
অন্য অনেক ডুবোপাহাড়ের মতো কার্টার সি-মাউন্টও পানির নিচে মৃত আগ্নেয়গিরি থেকে তৈরি। এসব ডুবোপাহাড়ের বেশির ভাগ নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে কার্টার সি-মাউন্টকে ঘিরে প্রবাল ও স্পঞ্জের দারুণ এক বাস্তুতন্ত্র ছড়িয়ে আছে।
সিলফ্রা ফিসার
‘সিলফ্রা ফিসার’ বা সিলফ্রা ফাটল আইসল্যান্ডের মাঝখানে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর একমাত্র স্থান, যেখানে আপনি দুই মহাদেশের ফাটলের মধ্যে সাঁতার কাটতে পারবেন। ইউরেশীয় ও উত্তর আমেরিকান প্লেট এখানে একত্র হয়েছে এবং ৬৩ মিটার পর্যন্ত গভীর ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। এ ফাটল প্রতিবছর দুই সেন্টিমিটার করে চওড়া হচ্ছে, যা এ দুই প্লেট এবং পৃথিবীর জন্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বলা হয়ে থাকে যে এখানেই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ পানি রয়েছে। এ পানির মধ্য দিয়ে ১০০ মিটারের বেশি দূরের জিনিসও দেখতে পাওয়া যায়।
চ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রবালপ্রাচীর
ভারত মহাসাগরের মধ্যাঞ্চলে চ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রবালপ্রাচীর সমুদ্রের টোয়াইলাইট জোনে অবস্থিত। পানির নিচে ২০০ থেকে ১০০০ মিটার গভীরের অঞ্চলকে টোয়াইলাইট জোন বলে। এ অঞ্চল পুরোপুরি অন্ধকার নয়, খুব সামান্য সূর্যালোক সেখানে পৌঁছাতে পারে। সমুদ্রের পানির নিচে ৪০ মিটারের বেশি গভীরে অবস্থিত প্রবালপ্রাচীর নিয়ে এ পর্যন্ত খুব বেশি গবেষণা হয়নি। চ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের ওই প্রবালপ্রাচীরে প্রবাল সামান্য সূর্যালোকেও বেঁচে আছে। এমনকি সেখানে প্রবালের এমন সব প্রজাতি পাওয়া গেছে, যেগুলো অগভীর জলরাশির প্রবালপ্রাচীরেও দেখা গেছে।
মেক্সিকোর ইউক্যাটান উপদ্বীপের ডুবন্ত গর্ত
চুনাপাথরের শিলাস্তম্ভ ধসে পড়ে মেক্সিকোতে কয়েক হাজার গভীর সিঙ্কহোল বা ডুবন্ত গর্ত তৈরি হয়েছে। এটি পানির নিচে বিশ্বের দীর্ঘতম গুহা ব্যবস্থার একটি অংশ। এসব গুহা ও গর্তগুলোর ওপরের অংশে মিঠাপানি ও নিচের অংশ নোনাপানি। মেক্সিকোর সিঙ্কহোলগুলো রহস্যেঘেরা। মায়া সভ্যতার লোকেরা বিশ্বাস করতেন, এ সিঙ্কহোলগুলো ‘পরকালের প্রবেশদ্বার’। তাঁদের কাছে এগুলো অত্যন্ত পবিত্র ছিল। অনেক সিঙ্কহোলে এখনো মানুষ যায়নি। তবে ডুবুরিরা পানির নিচে এ গুহা ব্যবস্থার মানচিত্র তৈরি করা শুরু করেছেন।