রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে দক্ষিণখান থানা পুলিশ। দক্ষিণখানের এক স্কুলে পড়ুয়া কিশোরী ১৬ জানুয়ারি অপহৃত হয়। অনলাইনের পরিচয়ের সূত্র ধরে মহাখালীর একটি ফ্ল্যাটে আনা হয় ওই কিশোরীকে। গণধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়া হয়। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিন (পেশা গাড়িচালক) ও রাব্বি মৃধা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত মঙ্গলবার রাতে হাতিরঝিলের ওয়াপদা রোডে মো. সুমন নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হন। তার বোন ইভা জানান, সুমন একটি ইন্টারনেট কোম্পানিতে লাইনম্যানের কাজ করেন। তাদের বাসা রামপুরা ওয়াপদা রোডের ২ নম্বর গলিতে। রাতে সামনের একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন সুমন। এ সময় ১০-১২ জন মুখোশধারী মোটরসাইকেলে এসে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। সুমন ডান পায়ের ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হন।
১ ফেব্রুয়ারি রাতে হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে জিলানী (৫৫) নামে এক পথচারী গুলিবিদ্ধ হন। তার মেয়ে শেফালী আক্তার জানান, তার বাবা একজন রিকশাচালক। গোলাগুলির সময় তার বাবা বাসার সামনে অবস্থান করছিলেন। গত ২৮ জানুয়ারি দুপুরে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে গাড়ি ডেকে রাজধানীর বনশ্রী থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার পথে হাতিরঝিল এলাকায় অপহরণের চেষ্টা করা হয় চিত্রনায়িকা নিঝুম রুবিনাকে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত উবারচালক মো. রকিকে গ্রেপ্তার করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি উদ্বোধনের পর থেকে হাতিরঝিল এলাকা থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে লেকের পানিতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩৬ জন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন ২০ জনের বেশি। এ ছাড়া ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেপরোয়া গতির যানবাহনে এখানে ঘটেছে শতাধিক দুর্ঘটনা। হতাহত হয়েছেন অনেকেই। তবে হাতিরঝিলের বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই ছিল রহস্যাবৃত্ত। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে হাতিরঝিল লেক থেকে ২৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ৭ মাসে ১৯ খুন, চারজনকে ধর্ষণ, ১৬ জনের আত্মহত্যা ও ১০টি ছিনতাইয়ের অভিযোগ জমা পড়েছে হাতিরঝিল থানায়। তবে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। দিনের হাতিরঝিল যতটা সুন্দর রাতের হাতিরঝিল যেন ততটাই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। খুন, ছিনতাই, মাদক, ইভ টিজিং, অপহরণ, কিশোর গ্যাং ও বখাটেদের উৎপাত যেন এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতিরঝিল চলে যায় অপরাধীদের দখলে। দিনেও থাকে বখাটেদের উৎপাত। প্রায়ই পথচারীদের আটকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে তারা। কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নাজেহাল হচ্ছে দর্শনার্থীরা। নানা অব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল নজরদারির কারণে এলাকাটি এখন অরক্ষিত ও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। পরিণত হয়েছে অপমৃত্যু এবং অপরাধের হটস্পটে। কিছু ক্ষেত্রে অন্যত্র হত্যার পর নিরাপদে লাশ ফেলতে হাতিরঝিলকেই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা।
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের মাঝামাঝি সময় থেকে হাতিরঝিল এলাকাটি নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের আস্তানায় পরিণত হয়। হাতিরঝিলের সঙ্গে আশপাশের অন্তত ৩৮টি গলির সংযোগ রয়েছে। সেখান থেকে বখাটেরা বের হয়ে বিভিন্ন অপরাধ করে অলিগলি দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। রাত বাড়লেই জনশূন্য হয়ে ওঠা হাতিরঝিলে দাপিয়ে বেড়ায় অপরাধীরা। স্থানীয়রা জানান, হাতিরঝিল নির্মাণ থেকে শুরু করে উদ্বোধনের পর পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করত সেনাবাহিনী। তখন কেউ অপরাধ করার সাহস পেত না। রাজউককে হাতিরঝিলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর থেকেই অপরাধ বেড়ে গেছে। পুরো হাতিরঝিল এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার কথা থাকলেও তা হয়নি। লেকের সেতুগুলোর অধিকাংশ বাতি নষ্ট। ঢিলেঢালা থাকে পুলিশের টহল। এসবের সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, হাতিরঝিল, গুলশান আর বাড্ডা- এই তিন থানার সীমানায় হাতিরঝিল এলাকা। ফলে তিন থানার পুলিশ বিভিন্ন সময় টহলে থাকে। গত ৫ আগস্টের পর হাতিরঝিল এলাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ও মাদক ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। যৌথ বাহিনীর অভিযানে প্রায়ই মাদক বাবসায়ী, কিশোর গ্যাং ও বখাটেদের আটক করা হচ্ছে। পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের কড়া নজরদারির কারণে এখন সেগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ডিএমপির হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাজু বলেন, ৫ আগস্টের পর হাতিরঝিল থানায় সব নতুন পুলিশ সদস্য এসেছে। ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। হাতিরঝিলকে ঘিরে ২৪ ঘণ্টা পুলিশের পাঁচটি প্যাট্রোল টিম ও বাইক প্যাট্রোল করানো হচ্ছে। ১১৮ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। প্রতিদিনই হাতিরঝিলে যৌথ বাহিনীর চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী, এপিবিএন, সিটিটিসি, ডিবি ও র্যাবের সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এতে বেশ সফলতাও আসছে। হাতিরঝিল এলাকার অপরাধ পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। নগরবাসীর সেবা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।