
মুয়াম্মার গাদ্দাফি, যিনি নিজেকে 'লিবিয়ার বিপ্লবী নেতা' এবং 'প্রভাবশালী মুসলিম নেতা' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁর ৪২ বছরের শাসন ২০১১ সালে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপে নির্মমভাবে শেষ হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফিলিস্তিনের কট্টর সমর্থক হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর আরব ঐক্য প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রচেষ্টা এবং পশ্চিমা নীতির বিরোধিতা করাই তাঁর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
গাদ্দাফি ১৯৭২ সালে 'ফেডারেশন অব আরব রিপাবলিকস' গঠনের মাধ্যমে আরব দেশগুলোকে একত্রিত করার যে চেষ্টা করেছিলেন, তা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রোষের কারণ হয়। ফিলিস্তিনের পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান তাঁকে পশ্চিমা বিশ্বের 'আতঙ্ক'-এ পরিণত করে।
এর জেরেই ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
২০০৯ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর জাতিসংঘে তাঁর ঝাঁজালো বক্তব্য এবং নীতিমালার অনুলিপি ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তোলে।
গাদ্দাফির চার দশকের শাসনে লিবিয়া বিশাল তেলসমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় দেশকে সামরিকভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন এবং প্রায় ৫০ হাজার সৈন্যের মাধ্যমে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর আমলে লিবিয়া আফ্রিকা ও এশিয়ার অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বিপুল অর্থ উপার্জনের এক লোভনীয় কর্মক্ষেত্র ছিল।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেনগাজি শহরে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গাদ্দাফি গোলাবারুদ ও যুদ্ধবিমান দিয়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নেয়।
বিক্ষোভ জোরালো হওয়ায় আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে। জাতিসংঘ গাদ্দাফিবিরোধী ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে (এনটিসি) সমর্থন দেওয়া শুরু করে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মদদে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সহায়তায় এনটিসি লিবিয়ায় আক্রমণ শুরু করে।
২০১১ সালের আগস্টে বিদ্রোহী বাহিনী ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সদর দপ্তর আল-আজিজিয়া কম্পাউন্ড দখল করে নেয় এবং এনটিসি লিবিয়ার অঘোষিত সরকারে পরিণত হয়।
ত্রিপোলির পতনের পর গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী সিয়ার্ত শহরে শেষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই শহরেই ২০১১ সালের অক্টোবরে গাদ্দাফি নির্মমভাবে নিহত হন।
রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, ফ্রান্সের বিমান হামলায় গাদ্দাফির গাড়িবহরের অন্তত ১৫টি ট্রাক বিধ্বস্ত হয়। গাদ্দাফিসহ কয়েকজন বড় একটি পাইপের ভেতরে আশ্রয় নিলেও কামানের গোলার মুখে তিনি বের হয়ে আসেন এবং তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এনটিসির প্রধান মাহমুদ জিবরিল বলেন, গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গাদ্দাফি নিহত হন। তবে আল-জাজিরার ভিডিওতে রক্তাক্ত গাদ্দাফিকে বিদ্রোহীদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়, যা তাঁর মৃত্যুকে আরও মর্মান্তিক করে তোলে।