Image description

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তালেবান তোষামোদিতে ক্ষুব্ধ কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতার। বলেছেন, লজ্জায় তাঁর মাথা কাটা যাচ্ছে।

ভারত সফররত আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে মোদি সরকারের রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়ার নিন্দা করে প্রবীণ এই কবি বলেছেন, যারা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড়াই করে তাদের এই স্খলন দেখে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।

ভারত সরকারের আমন্ত্রণে মুত্তাকি বর্তমানে এ দেশে রয়েছেন। তাঁকে ঘিরে প্রবল বিতর্ক দেখা দেয় গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ায়। সমালোচনার মুখে পড়ে পর দিন মুত্তাকি অবশ্য নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানান।

তবে তা সত্ত্বেও মোদি সরকারকে এই নতুন তালেবান প্রেম নিয়ে কটূক্তি শুনতে হচ্ছে। কবি ও হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গীতিকার জাভেদ আখতারের সমালোচনা তারই পরিচয়।

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে ভারত এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। আসলে রাশিয়া ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশই তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে।

রাশিয়া ও ভারত সফরের জন্য সেই নিষেধাজ্ঞা জাতিসংঘ সাময়িকভাবে শিথিল করেছে। ফলে রাশিয়া হয়ে মুত্তাকি ভারতে আসেন। হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেন। যদিও সেই বৈঠকে ভারত ও আফগানিস্তানের পতাকা ছিল না।

পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কহানি ও সে দেশের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির দরুন ভূকৌশলগত কারণে ভারত ও তালেবান নেতৃত্ব কাছাকাছি এসেছে। তালেবান সরকার পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের নিন্দাও জানিয়েছিল। ২০২১ সালে আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর এই প্রথম তালেবান সরকারের কোনো প্রতিনিধি সরকারি সফরে ভারতে এলেন।

হায়দরাবাদ হাউসে জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পর মুত্তাকি নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাসে ১১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেটা ছিল পুরোপুরি পুরুষ সংবাদকর্মীদের জন্য। নারী সাংবাদিকবর্জিত সংবাদ সম্মেলন করা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই নানা মহল সরব হয়। সমালোচনা ও প্রতিবাদের বন্যা বইতে থাকে।

তা থেকে বাঁচতে পরদিন ১২ অক্টোবর মুত্তাকি নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানান। সেখানে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আমন্ত্রিতদের তালিকা সংক্ষিত রাখা হয়েছিল। টেকনিক্যাল কারণে নারী সাংবাদিকদের ডাকা যায়নি। নেপথ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

ওই যুক্তি বা অজুহাত জাভেদ আখতারকে সন্তুষ্ট করেনি। ‘এক্স’ মারফত নিজের অখুশি প্রকাশ করে তালেবান নেতৃত্বের পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদি সরকারকেও একহাত নিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিকে নিয়ে ভারত সরকার যে আদিখ্যেতা দেখিয়েছে, তাতে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। ওই বাড়াবাড়ি করেছে সেই সরকার (ভারত) যারা সব ধরনের মঞ্চ থেকে সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে চলেছে।

জাভেদ আখতারের সমালোচনার হাত থেকে বাঁচেনি উত্তর প্রদেশের ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দও। নারীবর্জিত সংবাদ সম্মেলনের পর মুত্তাকি দেওবন্দে গিয়েছিলেন।

দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ মুত্তাকিকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়ায় জাভেদ লেখেন, দেওবন্দ তাদের ইসলামি হিরোকে মাথায় তুলে নেচেছে। অথচ তারাই নিজেদের দেশে নারীশিক্ষা শিকেয় তুলেছে। আমাদের কী যে হয়েছে কে জানে!

নারী বর্জনের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ায় মুত্তাকির পাশাপাশি ভারত সরকারও পড়ে প্রবল সমালোচনার মুখে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাফাই দিতে গিয়ে জানায়, সংবাদ সম্মেলনে তাদের কোনো হাত ছিল না।

সরকারের যুক্তি, সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেছিল আফগান সরকার। তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আফগানিস্তান দূতাবাসে যা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনৈতিক রক্ষাকবচের আওতাভুক্ত।

এই যুক্তি সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উঠতে থাকে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র, পি চিদম্বরমের মতো নেতারা সমালোচনায় মুখর হন।

স্ত্রী শাবানা আজমির সঙ্গে জাভেদ আখতার
স্ত্রী শাবানা আজমির সঙ্গে জাভেদ আখতারছবি: এএনআই

প্রতিবাদী হয় ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়াও। তাদের বক্তব্য, কূটনৈতিক রক্ষাকবচ থাকতেই পারে। ওই সিদ্ধান্তে ভারত সরকারের হাতও হয়তো ছিল না। কিন্তু তাই বলে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে কেউ এভাবে লিঙ্গবৈষম্য করবে অথচ সরকার তার প্রতিবাদ পর্যন্ত করবে না? এই নীরবতাই উদ্বেগের।উদ্বেগটা কেন এবং কতটা ভয়ংকর, ‘এক্স’ মারফত জাভেদ আখতারের বার্তা তারই পরিচায়ক। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারত সরকারের দ্বিচারিতাই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন।

বিহার নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের মাটিতে তালেবান লিঙ্গবৈষম্য ও নারীবিদ্বেষের ঢেউ বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে ভেবেই কি ভারত সরকার তালেবান নেতৃত্বকে নারী সাংবাদিকদের সম্মেলন ডাকার পরামর্শ দিয়েছিল?

প্রশ্নটি আলোচিত হলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। জাভেদ আখতারের সমালোচনার জবাবও সরকারিভাবে দেওয়া হয়নি। দলগতভাবেও বিজেপি নীরব।

আফগান শিখ ও হিন্দুদের দেশে ফিরতে বললেন মুত্তাকি

আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা শিখ ও হিন্দুদের এক প্রতিনিধিদল গত সোমবার তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে তাঁরা বলেন, সে দেশে অবস্থিত গুরুদ্বার ও মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়। ধর্মস্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করার দাবিও তাঁরা জানান।

প্রতিনিধিদল মুত্তাকিকে বলেন, দখল করা শিখ ও হিন্দু সম্পত্তি ফেরত দেওয়া হোক এবং তাঁদের আসা–যাওয়ার সুবিধার জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা দেওয়া হোক।
চলে আসা শিখ ও হিন্দুদের দেশে ফেরার পরামর্শ দেন মুত্তাকি। তিনি বলেন, ‘আপনারা দেশে ফিরুন। নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য নতুনভাবে শুরু করুন। সরকার আপনাদের স্বাগত জানাবে।’