
আরাকান আর্মির আতঙ্কে মিয়ানমার সীমান্তের জেলেরা। নাফ নদ এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এমনকি মাছ ধরার ট্রলারসহ জেলেদের অপহরণ করে মোটা অংকের মুক্তিপণও আদায় করছে মিয়ামারের এই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। মুক্তিপণের টাকা না দিলে নিজেদের ডেরায় আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।
প্রাণ ভয়ে অনেক জেলে পরিবার তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে দরকষাকষির পর মুক্তিপণের টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছে। চাহিদার টাকা নগদে, ব্যাংকিং কিংবা বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে। অনেক সময় নৌযানে থাকা মাছ, জ্বালানি, খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য মালামাল লুটে নিচ্ছে আরাকান আর্মি। একের পর এক বাংলাদেশি জেলে অপরহরণ ও নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে জেলেদের মধ্যে। ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি সাগর থেকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) আরও ১৪ জেলেকে ধরে নিয়ে যায়।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির হাতে অপহৃত হয়েছেন ৩৪০ জন বাংলাদেশি জেলে। এর মধ্যে প্রশাসন ১৮৯ জেলে এবং ২৭টি নৌযান ফেরত আনতে পেরেছে। বাকিদের ফেরত আনার বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। এতে আতঙ্কের পাশাপাশি অপহৃত জেলে পরিবারে শোক বইছে। দেখা দিয়েছে অভাব-অনটন।
অপহৃত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা বলছেন, গত মাসে এরকম ১২০ জন জেলেসহ সাতটি নৌযান নিয়ে গেছে তারা। নাফ নদী বাংলাদেশে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সীমান্তে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে আলাদা করেছে। নদীটির মোহনা এবং সেন্ট মর্টিন দ্বীপের দক্ষিণ সাগরে মাছ ধরেই মূলত জীবিকা নির্বাহ করেন বাংলাদেশি জেলেরা।
কিন্তু একের পর এক জেলেকে আরাকান আর্মির সদস্যরা ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আতঙ্কে জেলেদের অনেকেই সাগরে মাছ ধরতে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতে করে শ’ শ’ টন মাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। আড়তে সরবরাহ প্রায় বন্ধ থাকায় বাড়ছে দাম। অভাব-অনটনে দিন কাটছে জেলেদের। নিখোঁজ পরিবারগুলোয় বইছে শোকের মাতম।
বাংলাদেশের কোস্টগার্ড বলছে, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে কোনো আটকের ঘটনা ঘটছে না। দেশের সীমানার বাইরে জল সীমানায় জেলেদের অপহরণের ঘটনা ঘটছে।
টেকনাফ কায়ুকখালী বোট মালিক সমিতির পরিচালক সাজেদ আহমেদ জানান, টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীয়া ঘাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৫০টি মাছ ধরার নৌযানে তিন হাজার জেলে নাফ নদের মোহনা ও সাগরে মাছ ধরতে যায়।
মিয়ানমারের মংডুর সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। নাফ নদটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা ভাগ করে রেখেছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে টানা ১১ মাসের সংঘাতের পর গত বছরের আগস্টে রাখাইনের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। এরপর থেকে নাফ নদের মিয়ানমার অংশে মাছ ধরায় একধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে তারা।
৩০ সেপ্টেম্বর সকালে কায়ুকখালী ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে যায়। এর মধ্যে মো. কালাম ও সৈয়দ আহমদের মালিকানাধীন দুটি ট্রলারসহ ১৪ মাঝিমাল্লাকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি।
বারবার এ ধরনের ঘটনায় জেলেদের মধ্যে ভীতি তৈরি হচ্ছে। মাছ শিকার এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জীবিকার তাগিদে পেশাজীবী জেলেরা ট্রলারযোগে দিনরাত নাফ নদ সংলগ্ন দেশের অভ্যন্তরে সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে প্রায়ই আরাকান আর্মির রোষানলে পড়ছে।
ধাওয়া করে অস্ত্রের মুখে জিম্মির পর ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে মিয়ানমারের এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। এতে জেলে ও তাদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এখনো যারা বন্দি রয়েছেন, তাদের ছাড়িয়ে আনতে স্থানীয় প্রশাসনসহ সাগরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার হস্তক্ষেপ চায় জেলেরা।
গত ১২ সেপ্টেম্বর আরাকান আর্মি পাঁচটি ট্রলারের ৪০ মাঝিমাল্লাকে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে ১৭ জন কৌশলে পালিয়ে এলেও বিভিন্ন সময় ধরে নিয়ে যাওয়া আরও ১১৮ জেলে এখনো ওই গোষ্ঠীর হাতেই বন্দি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রলারসহ ১৪ জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। এর আগে আরকার আর্মি প্রায় সাড়ে ৩শ’র বেশি বাংলাদেশি জেলে অপহরণ করে।
কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহমুদুল হাসান জানান, জেলেরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমারেখা অতিক্রম করার কারণে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু নাফ নদকে ঘিরে হঠাৎ কেন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো? আর বাংলাদেশি জেলেদের নিরাপত্তায় কোস্টগার্ড কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটাও এখন আলোচনায়।
জেলেদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ॥ ২৬ আগস্ট টেকনাফের শাহপরী দ্বীপের বাসিন্দা রশিদ আহমেদের ছেলেকে তার চোখের সামনেই নাফ নদ থেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এক মাসের বেশি সময়ের সেই ঘটনার সময় রশিদ আহমেদ নিজেও মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, হঠাৎ দেখি স্পিড বোটে করে সশস্ত্র অবস্থায় আরাকান আর্মি আসছে। আমি ছিলাম অন্য নৌকায়।
আমার ছেলেসহ তারা ছিলো আরেকটা নৌকায়। ওরা স্রোতের টানে একটু দূরে চলে গিয়েছিল। আমরা পালিয়ে আসতে পারলেও ওরা ¯্রােতের টানে আসতে পারে নাই। স্পিড বোট আসি ধরি ফেলাইছে। রশিদ জানান, স্পিডবোটে আসা সবার হাতেই অস্ত্র ও বন্দুক ছিল। গাছের পাতার মতো পুলিশের মতো ড্রেস সবার গায়ে ছিল।
এর আগে টেকনাফের নাফ নদ থেকে বোর্ডসহ ৫ জনকে ধরে নিয়ে গেছে আরকান আর্মিরা। তাদের মধ্যে শাহপরী দ্বীপের বাসিন্দা আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা আনিসা খাতুনের স্বামী ইমাম হোসেনও ছিল। তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তার স্বামী এবং অন্যরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, তারা জানেন না। কোনো খোঁজ-খবরও পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে পাঁচ জেলে নিখোঁজ হবার কয়েকদিন পর মিয়ানমারের একটি ওয়েবসাইটে ইমাম হোসেনসহ অন্য জেলেদের ছবি প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়ায় আরাকান আর্মি তাদের গ্রেপ্তার করেছে। মোবাইলে সেই খবরে আটক পাঁচ জেলের ছবি দেখিয়ে ইমাম হোসেন ও অন্যদের পরিচয় শনাক্ত করেন স্বজনেরা।
টেকনাফের নাফ নদের বাসিন্দা লিয়াকত হোসেন জানান, তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস নাফ নদে মাছ শিকার। কিন্তু বর্তমানে আরাকান আর্মির ভয়ে তারা নদে যেতে পারছেন না।
আরাকান আর্মির কবল থেকে বেঁচে ফেরা নুর মোহাম্মদ জানান, ওইদিন সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ সাগরের নিকটবর্তী সীতা নামক স্থানে জেলেরা মাছ ধরছিল। সে সময় দুটি স্পিড বোটযোগে এসে আরাকান আর্মির সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেয়। এরপর আটক।
কিভাবে নিখোঁজ ॥ নাফ নদ এবং সাগরে নিরাপত্তার দেখভাল করে কোস্টগার্ড। নৌপথে কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল কার্যক্রমও চলে। কিন্তু এই টহল কার্যক্রমের মধ্যেই একের পর এক বাংলাদেশি জেলে কীভাবে নিখোঁজ হচ্ছেন কিংবা আরাকান আর্মি তাদের কীভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। যদিও কোস্টগার্ড বলছে, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে কেউ আটক বা নিখোঁজ হচ্ছে না।
কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহমুদুল হাসান জানান, আমাদের টিম জলসীমায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেশিরভাগ সময় দেখেছি, জেলেরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার যে সীমারেখা আছে, সেই সীমারেখা অতিক্রম করার কারণে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বেশি মাছ ধরার আশায় অথবা অসাবধানতাবশত: তারা বাংলাদেশের সীমারেখা অতিক্রম করছে। এজন্য বাংলাদেশের জলসীমা ঘিরে টহল কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়েছে। কোথায় মাছ ধরা ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো জানানো এবং সীমান্ত রেখা অতিক্রম না করতে সতর্ক করা এবং কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।
এরমধ্যেই গত ২৯ আগস্ট নাফ নদের মোহনা ও সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১২২ জন জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। সেসময় বাহিনীর তরফ থেকে দেওয়া বক্তব্যে জানানো হয়েছিল। এসব জেলেরা বাংলাদেশ সীমারেখা অতিক্রম করে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকেছিলেন।
কোস্টগার্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, অসাবধানতা এবং বেশি মাছ পাওয়ার আশায় জেলেরা তাদের সীমানায় ঢুকে পড়ছে। এর বাইরে আরও দুটি কারণের কথা বলছেন জেলেরা। এর একটি হচ্ছে, নাফ নদীর মোহনায় নাইক্ষংদিয়া এলাকায় ডুবোচরের কারণে বাংলাদেশ অংশে পানির গভীরতা কমে গেছে। কিন্তু মিয়ানমারের জলসীমা ঘেঁষে পানির গভীরতা বেশি থাকায় অনেকে সেই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন।
আরেকটি কারণ হচ্ছে, মাছ ধরার সময় তীব্র ¯্রােতে কখনো কখনো নৌকা ভেসে মিয়ানমারের অংশে চলে যায়। যদিও আগে বিভিন্ন সময় জেলেরা এভাবে তাদের জলসীমানা ঢুকে পড়ছে। কিন্তু তখন মিয়ানমার আটকায়নি। এখন আরাকান আর্মি আসার পরে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে।