
মার্কিন অণুজীববিজ্ঞানী মেরি এলিজাবেথ ব্রুনকো চলতি বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন জীববিজ্ঞানী ফ্রেড র্যামসডেল এবং জাপানের চিকিৎসক শিমোন সাকাগুচি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে ‘পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স’ নিয়ে গবেষণার জন্য তাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন তাঁরা।
আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের কোষকে ভুল করে আক্রমণ করে না। কীভাবে শরীর এই কাজটি করে, সেটাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরটি শুনে মেরি ব্রুনকোর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? চলুন জেনে নিই।
‘ফোনটা অসময়ে বেজে উঠল। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটা। দেখলাম, সুইডেন থেকে কল এসেছে। ভাবলাম, এটা নিশ্চয়ই কোনো স্প্যাম কল। তাই ফোনটা কেটে দিয়ে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।’
মেরি ব্রুনকো স্টকহোম থেকে কোনো কল আশা করেননি। নোবেল পুরস্কার কমিটির পক্ষ থেকে অ্যাডাম স্মিথ তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। সেই সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা নিচে তুলে ধরা হলো। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য মেরি ব্রুনকোর সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক জিনাত শারমিন।
মেরি ব্রুনকো: হ্যালো।
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যালো, আমি কি মেরি ব্রুনকোর সঙ্গে কথা বলছি?
মেরি: হ্যাঁ।
অ্যাডাম: আমি অ্যাডাম স্মিথ, নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ থেকে বলছি।
মেরি: ওহ, দারুণ ব্যাপার! আচ্ছা, আমি কি আপনার কলটা স্পিকারে দিতে পারি?
অ্যাডাম: নিশ্চয়ই। আপনি কোথায়? রান্নাঘরে?
মেরি: না, আমি ডাইনিং টেবিলে।

অ্যাডাম: খবরটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছেন। কীভাবে জানলেন?
মেরি: ঘণ্টা দেড়েক আগে আমার ফোনে সুইডেন থেকে একটি কল এসেছিল। আমি ভেবেছিলাম, ওটা কোনো স্প্যাম কল। তাই ফোন কেটে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর দেখি, আমার স্বামী ওপরতলায় একজনের সঙ্গে কিছুটা উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। তিনি ছিলেন বার্তা সংস্থার (এপি) একজন সাংবাদিক। তিনিই প্রথম আমাকে চিৎকার করে নোবেল পাওয়ার খবরটি দেন। এরপর দেখি, স্থানীয় টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার সাংবাদিকেরা বাসার সামনে ভিড় করেছেন। তাঁরা এখন ভেতরের বারান্দায় বসে আছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা ছবিও তুলেছেন। এখন ভোর সাড়ে চারটা বাজে। আর আমি ডাইনিং টেবিলে বসে আপনার সঙ্গে কথা বলছি।
অ্যাডাম: বাহ! পাশে কি আপনার স্বামী? গলা শুনতে পাচ্ছি... বাড়িতে আর কে আছেন?
মেরি: হ্যাঁ, আমার স্বামী পাশে আছেন। আমাকে ফোনে না পেয়ে সবাই ওর ফোনেই কল দিচ্ছে। বাড়িতে আমাদের একটি পোষা কুকুরও আছে। ও বেশ ভড়কে গেছে। কুকুরটা বুঝতে পারছে বাড়িতে বিশেষ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু ঠিক কী হয়েছে, তা বুঝতে না পারায় ও দ্বিধাগ্রস্ত।
অ্যাডাম: ঠিক বলেছেন, কুকুরটার তো এই সময় জেগে থাকার কথা না। পুরস্কারের খবরের জন্য অভিনন্দন!
মেরি: ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।
অ্যাডাম: মনে হচ্ছে আপনি এই খবর একদমই আশা করেননি।
মেরি: না, একেবারেই না।

অ্যাডাম: এই পুরস্কার আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মেরি: আমার মাথা এখনো ঠিকমতো কাজ করছে না। আমরা যখন গবেষণা শুরু করেছিলাম, তখন দলের সবাই নিজেদের সেরাটা দিয়ে কাজ করেছে। এটি ছিল একটি অসাধারণ দলগত প্রচেষ্টা। আমি চিকিৎসাক্ষেত্রে এই আবিষ্কারের প্রভাব দেখেছি। মানুষের জীবন রক্ষায় বা সুস্থতায় আমি যে সামান্য ভূমিকা রাখতে পেরেছি, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দ। পুরস্কারটি তো কেবল ‘বাইপ্রোডাক্ট’। এর বাইরে কী বলব… আমি সম্ভবত এখনো আমাদের পোষা কুকুরটির মতোই কিঞ্চিত ঘোরের মধ্যে আছি। কী ঘটেছে, তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।
অ্যাডাম: আপনি একজন অসাধারণ জেনেটিসিস্ট। ১৯৯৮ সালে কোনো জিন ক্লোন করা বা খুঁজে পাওয়া এখনকার মতো সহজ ছিল না। তখন আপনি সেটা করেছিলেন।
মেরি: এখন বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে। একটা সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হয়েছে।
অ্যাডাম: জেনেটিকস আসলেই জীববিজ্ঞানের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে দারুণ ক্ষমতা দেখিয়েছে।
মেরি: অবশ্যই। আমরা আমাদের কাজটি শুরু করেছিলাম ‘স্কার্ফি’ ইঁদুরের একটি মিউটেশন নিয়ে। এই ইঁদুরগুলোর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় একটি ত্রুটি ছিল। ফলে অল্প বয়সেই মারাত্মক অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়ে এরা মারা যেত। আমরা প্রথমে সেই ইঁদুরগুলোর রোগ সারানোর চেষ্টা করি। তখন খেয়াল করি, একই রকম একটি সমস্যা মানুষের মধ্যেও দেখা যায়। এটি একটি বিরল শিশুরোগ। মানুষ ও ইঁদুর—উভয় ক্ষেত্রেই এর সমাধান অনেকটা একই রকম। বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু একবার আমরা সম্ভাব্য জিনের অবস্থান জানতে পারলাম। এরপর থেকেই শুরু হলো আসল গবেষণা। এটি ছিল দীর্ঘ এক ‘মলিকুলার যুদ্ধ’। কারণ খুব ক্ষুদ্র একটি জেনেটিক পরিবর্তনই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশাল প্রভাব ফেলছিল।
অ্যাডাম: সত্যিই। কিন্তু স্কার্ফি ইঁদুর ও আইপেক্স রোগের মধ্যে যে সংযোগটা আপনি খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটা কোনো সহজ কাজ ছিল না।
মেরি: অবশ্যই সহজ ছিল না।

অ্যাডাম: শেষ পর্যন্ত তো রোগীদের জন্যই এটি আশার আলো হয়ে উঠল।
মেরি: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তবে এতে আমার কৃতিত্ব সামান্যই। দিনশেষে এটা একটা মেধাবী জীববিজ্ঞানীদের সফল দলগত প্রচেষ্টা।
অ্যাডাম: ঠিক বলেছেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সাংবাদিকদের আরও একটা দল জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমি আপনাকে তাঁদের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মেরি: ধন্যবাদ।
অ্যাডাম: বিদায়। এই মুহূর্তটা উপভোগ করুন।
মেরি: ধন্যবাদ।