Image description

করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের ধাক্কা আসে। পরে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর পাঁচ বছর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। অটোপাসের পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়া হয় এসএসসি ও এইচএসসিসহ অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বছরও সব বিষয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফলাফল ঘোষণা করে শিক্ষা বোর্ডগুলো।

চলতি বছর সে ধারা থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে দেশের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা। সবগুলো বিষয়ে হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। উত্তরপত্র দেখার ক্ষেত্রেও ছিল কড়াকড়ি। কাউকে বাড়তি সুবিধা না দিয়ে পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে এবারের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। ফলে গত কয়েক বছরের অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আগামী ১৮ অক্টোবরের মধ্যে স্বাভাবিক ফলাফল প্রকাশ করতে যাচ্ছে শিক্ষাবোর্ডগুলো।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অটোপাস ও সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে আগের বছরগুলোয় পাসের হার বেশি থাকার পাশাপাশি প্রচুর শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরায় উত্তরপত্র দেখার ক্ষেত্রে কড়াকড়িসহ মেধার ভিত্তিতে ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশনা থাকায় পাসের হারেও প্রভাব পড়বে।

এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হ্যাপি আক্তার বলেন, এসএসসি ও এইচএসসির ভালো ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তবে কোনো কারণে যদি এইচএসসির ফল খারাপও হয়, তাহলেও পরিবারের সদস্যদের উচিত পরীক্ষার্থীকে বকাঝকা না করা। বরং তাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া উচিত। তাকে বোঝানো উচিত, রেজাল্ট অন্যদের চেয়ে খারাপ হলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালোভাবে নিলে সেটা কাভার করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং পরীক্ষা যাতে ভালোভাবে দিতে পারে, সে ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। একটি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর জীবন থেমে থাকে না। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পরও তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিবারের কেউ খারাপ রেজাল্ট করলে তার সামনে এসব দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়া উচিত।

স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পর ফলাফলের এমন প্রভাব দেখা গেছে, চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়ও। পাসের হার ও জিপিএ-৫, দুটিই কমে। পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫। জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। আগের বছর পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। জিপিএ–৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী।

এতে চলতি বছরের এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পাস কমার পাশাপাশি জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যাও কমতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। সবার ক্ষেত্রেই একই অবস্থা হওয়ায় এসব মাথায় না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

রাজধানীর একটি কলেজের প্রভাষক মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘এসএসসির মতো অন্যবারের চেয়ে এবার এইচএসসিতেও পাস কমতে পারে বলে ধারণা করছি। তবে এই পরীক্ষাই যে জীবনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে, বিষয়টি এমন নয়। এবার পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে ফলাফল প্রকাশ করায় সবার প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে। সে অনুযায়ী, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য তারা প্রস্তুতি নিলে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারবে বলে আশা করি।’

স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পর ফলাফলে এমন প্রভাব দেখা গেছে, চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়ও। পাসের হার ও জিপিএ-৫, দুটিই কমে। পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৪৫। জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। আগের বছর পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। জিপিএ–৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী।

এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়া একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ও রমজানের কারণে এবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা এগিয়ে নিয়ে আসছে বলে জানা যাচ্ছে। আবার এইচএসসি পরীক্ষার খাতা দেখায়ও কড়াকড়ি আছে। এতে তারা কিছুটা চাপে আছেন সত্য। তবে এমন অবস্থা এক-দুই জনের নয়, সবার। ফলে সার্বিক বিবেচনায় এটি তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন তারা।

২০১৯ থেকে ২০২৪: স্বাভাবিক ছিল না এইচএসসি পরীক্ষা-ফল
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার মূল্যায়নে পাস করেন সবাই, অর্থ্যাৎ সবাই অটোপাস করেন। ওই বছর পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন। এর মধ্য জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন পরীক্ষার্থী, যা মোট পরীক্ষার্থীর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। 

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়া ২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করে ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন, যা উত্তীর্ণের মোট সংখ্যার ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ৯ সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন।

২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। এতে গড় পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যা আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন।

২০২৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪। আগের বছরের চেয়ে পাসের হার কমে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। ১১ শিক্ষা বোর্ডে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পান ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। আগের বছরের চেয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কমে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন।

গণঅভ্যুত্থানের কারণে ২০২৪ সালে কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফলাফল দেওয়া হয়। এ বছর ৯ সাধারণ ও মাদরাসা এবং কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সে হিসেবে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বাড়ে ৫৩ হাজার ৫৪৬ জন। ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। 

এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল কবে প্রকাশিত হতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ফল প্রকাশের চূড়ান্ত কোনো তারিখ নির্ধারণ না হলেও ৬০ দিনের মধ্যেই ফল প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বোর্ড চেয়ারম্যানদের। বোর্ড চেয়ারম্যানরা ৬০ দিনের মধ্যেই ফল প্রকাশের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আশ্বস্ত করেছে।

আর চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের লিখিত পরীক্ষা গত ১৯ আগস্ট শেষ হয়। ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২১ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় বসেন ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫ ছাত্র এবং ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬ ছাত্রী। সারাদেশে ২ হাজার ৭৯৭টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়। এর মাধ্যমে প্রায় পাঁচ বছর পর স্বাভাবিক ব্যবস্থায় পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ই‌লিয়াছ উ‌দ্দিন আহাম্মদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘পরীক্ষার খাতায় যা লিখেছেন শিক্ষার্থীরা, তার ফলাফলই পাবেন। এসএসসি যে স্টাইলে, যে চিন্তায় উপদেষ্টা ও সচিব যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এই নির্দেশনা এইচএসসিতেও দিয়েছেন। তা অনুসরণ করেই ফলাফল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেব।’

তিনি বলেন, ‘কারও প্রতি কোনও দয়া বা অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই। সব হবে পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে। ফলাফল কেমন হবে, সে বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। শিক্ষার্থী যেভাবে উত্তর দিয়েছে, সেটা যথার্থভাবে মূল্যায়ন করেছি। সেটার ভিত্তিতেই ফলাফল প্রকাশের প্রক্রিয়ায় যাচ্ছি।’

চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ নিয়ে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সভায় বসছেন বোর্ড চেয়ারম্যানরা। এতে প্রস্তুতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী ফলাফল প্রকাশের তারিখ ঘোষণা করবে মন্ত্রণালয়। ১৮ অক্টোবরের মধ্যেই ফলাফলের সবকিছু সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আজ বুধবার (৮ অক্টোবর) একটি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা ফলাফল নিয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আমাদের সভা সভা হবে। আমাদের অবস্থান মন্ত্রণালয়কে জানাব। পরে মন্ত্রণালয় তাদের অবস্থান জানাবে। এইচএসসির ফলাফল নিয়ে ১৮ অক্টোবরের আগেই আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হচ্ছে।’

এর আগে বোর্ড চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সভা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। গত সোমবার মন্ত্রণালয়ে শিক্ষা সচিব রেহেনা পারভীনের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৯টি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন।

সভা সূত্রে জানা গেছে, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল কবে প্রকাশিত হতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ফল প্রকাশের চূড়ান্ত কোনো তারিখ নির্ধারণ না হলেও ৬০ দিনের মধ্যেই ফল প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বোর্ড চেয়ারম্যানদের। বোর্ড চেয়ারম্যানরা ৬০ দিনের মধ্যেই ফল প্রকাশের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আশ্বস্ত করেছে।

সভার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মো. মজিবর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ফল প্রকাশ নিয়ে শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ১৯ অক্টোবরের মধ্যেই ফল প্রকাশ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা ১৯ অক্টোবর ফল প্রকাশের কথা বলেছি। তারা এর আগেও ফল প্রকাশ করতে পারেন বলে জানিয়েছেন।’