Image description

মার্কিন চাপের মুখে ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির আলোচনায় গতি আনছে সিরিয়া। দামেস্ক আশা করছে, এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল সম্প্রতি যে ভূমি দখল করেছে, তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে তাদের কাছে। তবে এটি পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তিতে রূপ নেবে না বলেই মনে করছে আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। তাদের মতে, আলোচনার অগ্রগতি হলেও তা সীমিত পর্যায়ের একটি সমঝোতায় থামতে পারে।

ওয়াশিংটন চাইছে এ মাসের শেষে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরুর আগে আলোচনায় অন্তত কিছু অগ্রগতি হোক। এতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কে গিয়ে এই সাফল্যকে নিজের কৃতিত্ব হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন। চারটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, আলোচনার সাফল্য যতই সীমিত হোক না কেন, ট্রাম্প সেটিকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের এক বড় কূটনৈতিক জয় হিসেবে উপস্থাপন করবেন।

তবে বাস্তবে পরিস্থিতি অনেক জটিল। ইসরায়েল কয়েক মাস ধরে চলা আলোচনায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সিরিয়ার ভেতরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও দক্ষিণাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় দামেস্ক দুর্বল অবস্থানে আছে। আলোচনায় অবহিত ৯ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স—এর মধ্যে আছেন সিরিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তা, দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, সিরিয়ার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—সম্প্রতি দখলকৃত এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতির অধীনে গঠিত নিরস্ত্রীকৃত বাফার জোন পুনর্বহাল এবং ইসরায়েলের বিমান হামলা ও স্থল অভিযান বন্ধ করা। তবে গোলান মালভূমির প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি। দামেস্কের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র বলেছে, গোলানের প্রশ্ন ‘ভবিষ্যতের জন্য রাখা হয়েছে।’

তবে গোলান নিয়েই সবচেয়ে বড় জটিলতা। ছয়টি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদেও এ অঞ্চল ফেরত দিতে রাজি নয় ইসরায়েল। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদেই গোলানকে একতরফাভাবে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বরং, ইসরায়েল মার্কিন দূত টমাস বারাকের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে দক্ষিণ সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে গোলান ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমাদের মার্কিন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, সেটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব।’

এক সিরিয়ার কর্মকর্তা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বুঝতে পারছেন যে, গোলান নিয়ে ছাড় দিলে তাঁর শাসন টিকবে না। তাই তিনি বারাককে বলেছেন, নিরাপত্তা চুক্তি ১৯৭৪ সালের সীমারেখার ভিত্তিতে হতে হবে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ আলোচনায় জোর দিচ্ছে। এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়াকে চাপ দিচ্ছে নিরাপত্তা চুক্তি দ্রুত করার জন্য—এটি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। তিনি চান মধ্যপ্রাচ্যে এক বড় কূটনৈতিক সাফল্যের স্থপতি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে।’ কিন্তু ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ইসরায়েল খুব বেশি কিছু দিচ্ছে না।’

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও আলোচনার নেতৃত্ব দেওয়া রন ডারমারের কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ওয়াশিংটন ‘ইসরায়েল, সিরিয়া ও প্রতিবেশীদের মধ্যে টেকসই স্থিতিশীলতা ও শান্তি বয়ে আনবে—এমন যেকোনো প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।’

আলোচনায় প্রবল অবিশ্বাসের ছায়া রয়ে গেছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেওয়া এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, ‘প্রাথমিক আস্থার উপাদানই নেই।’ সিরিয়ার পক্ষও বলছে, শারা যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে আলোচনায় গতি আনছেন, তবে এখনো বিস্তৃত শান্তিচুক্তির পরিবেশ তৈরি হয়নি।

এদিকে, মাঠের বাস্তবতায় শারার পথ আরও সংকীর্ণ। একদিকে, ইসরায়েলের হামলা ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের সমর্থন জনমনে ক্ষোভ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, সিরিয়ার ভেতরে ভূমি দখল দামেস্কের জন্য বড় হুমকি। সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বে থাকা এক সিরিয়ার সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলি টহল এড়িয়ে চলে। তাঁর মতে, ‘তারা প্রায়ই গ্রামে ঢুকে বাড়ি-বাড়ি খোঁজখবর নেয় এবং অস্ত্র খোঁজে।’

রয়টার্সের প্রশ্নে ইসরায়েলি সেনারা দাবি করেছে, তাদের অভিযান অস্ত্র জব্দ, চোরাচালান ঠেকানো এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকানোর জন্য। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ স্পষ্ট করে বলেছেন, হারমোন পাহাড়ে নতুন যে অবস্থান নিয়েছে ইসরায়েল, সেটি ছাড়বে না।

গাজা ও লেবাননের মতো এখন দক্ষিণ সিরিয়াতেও বিস্তৃত নিরস্ত্রীকৃত এলাকা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে ইসরায়েল বলে বিশ্লেষকদের মন্তব্য। সিরিয়ার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ওয়ায়েল আলওয়ান বলেন, ‘যেমন উত্তর গাজা ও দক্ষিণ লেবাননে করেছে, তেমনি এখন দক্ষিণ সিরিয়ায়ও বিস্তৃত নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল গড়ে তুলছে ইসরায়েল।’

সুয়াইদায় দ্রুজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সিরিয়ার বাহিনীর সংঘর্ষে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। বেসামরিক হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে সিরিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এর পর থেকে দ্রুজ নেতারা স্বাধীনতার দাবি তুলছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গোলান থেকে সুয়াইদা পর্যন্ত মানবিক করিডরের প্রস্তাব তুলেছেন। দুই প্রবীণ দ্রুজ নেতা রয়টার্সকে বলেছেন, ইসরায়েল এখন বিভক্ত দ্রুজ গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করছে এবং অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে। এমনকি ৩ হাজার দ্রুজ যোদ্ধার একটি বাহিনীর বেতনও দিচ্ছে তারা। যদিও স্বাধীনভাবে এ তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এ অবস্থায় শারা জানেন, ইসরায়েলকে উত্তেজিত করলে তাঁর পুনর্গঠন পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী বলেছেন, ‘উসকানি এড়িয়ে চলাই তাঁর পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু।’ অন্যদিকে, বিশ্লেষকেরা বলছেন অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও বৈদেশিক সহায়তার জন্য শারা কিছু বাস্তববাদী ছাড় দিতে পারেন। তবে গোলান মালভূমি নিয়ে কোনো সমঝোতায় যাওয়া তাঁর জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়াবে।

সব মিলিয়ে সিরিয়া-ইসরায়েল আলোচনার বর্তমান অগ্রগতি একদিকে মার্কিন প্রশাসনের কূটনৈতিক সাফল্যের প্রচেষ্টার অংশ, অন্যদিকে শারার জন্য এক সংকীর্ণ পথ। তিনি ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা পূরণ করতে চাইছেন, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বৈধতা ও ভূখণ্ড রক্ষার চাপে তাঁর বিকল্প সীমিত হয়ে পড়ছে।