Image description

তরুণদের দুই দিনের টানা বিক্ষোভ, সংঘাত ও রক্তপাতের পর নেপালে থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। এরপরই নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।

চলমান এ সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পেতে সহযোগিতার জন্য তরুণ বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল।

গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট পাওদেল বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, নাগরিকদের উত্থাপিত দাবিগুলো আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা যায়, যেখানে জেন-জি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণও থাকতে পারে।’

নেপালের পার্লামেন্টে এখন কোনো দলের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই আইনপ্রণেতারা খুব সম্ভবত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন।
বিনয় মিশ্রা, নেপালভিত্তিক জননীতি বিশ্লেষক

এর আগে চলমান সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে বিক্ষোভকারীদের আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছেন নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেল। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় সেনাপ্রধান এ আহ্বান জানান।

নেপালের সেনাপ্রধান বলেছেন, জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিক্ষোভে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

ভারতীয় পত্রিকা দ্য উইক জানিয়েছে, গতকাল নেপালের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ‘অন্যায্য সুযোগ’ না নেওয়ার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা কার্যক্রমের দায়িত্ব নিয়েছে।

গতকাল বিকেলে কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের ঘোষণার পর নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেলের পদত্যাগের গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েকটি গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবরও প্রকাশ পেয়েছিল।

বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান নেপালের সেনাপ্রধানের

 

পরে নেপালের সেনাবাহিনী জানায়, প্রেসিডেন্ট পাওদেল পদত্যাগ করেননি।

অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য, ঘৃণা ছড়ানোসহ নানা অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে নেপালে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে কোম্পানিগুলোকে নেপালের আইন মেনে নিবন্ধন করতে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু টিকটক, ভাইবারসহ আরও পাঁচটি অ্যাপ সরকারের শর্ত মেনে নিবন্ধন করালেও অন্যগুলো তা করেনি। এতে ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা লিংকডইনের মতো অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্মগুলোয় নেপাল থেকে ঢোকা যাচ্ছিল না।

নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল
নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেলফাইল ছবি: রয়টার্স

সরকারের এই সিদ্ধান্ত নেপালি তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম বন্ধের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে দেশটিতে ‘নেপো কিডস’ ও ‘নেপো বেবিস’ হ্যাশট্যাগ জনপ্রিয় হচ্ছিল।

ধনী রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন, স্বজনপ্রীতির কারণে সব ক্ষেত্রে তাঁদের স্পষ্ট সুবিধাভোগ এবং অনলাইনে এসব নিয়ে তাঁদের নির্লজ্জ প্রদর্শন নেপালের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছিল।

অনেকের মতে, সম্পদ ও বিশেষ সুবিধার এই নির্লজ্জ প্রদর্শন নেপালের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।

অনলাইনে তরুণদের এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। গত সোমবার কয়েক হাজার তরুণ রাজধানী কাঠমান্ডুসহ নেপালের আরও সাতটি শহরে রাজপথে নেমে বিক্ষোভ শুরু করে।

জেন–জি প্রজন্মের তরুণদের এই বিক্ষোভ দমনে কঠোর হয় সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে সেদিন ১৯ জন নিহত এবং কয়েক শ বিক্ষোভকারী আহত হন।

এমন পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে যায় অলি সরকার। বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে সোমবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

কিন্তু আগের দিন বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের প্রতিবাদে গতকাল ভোর থেকেই তাঁরা আবার রাস্তায় নামেন। তাঁদের থামাতে কারফিউ জারি করা হয়। বিক্ষোভকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে বিভিন্ন সরকারি ভবন ও সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর চালান এবং আগুন দেন।

গতকালও দুই বিক্ষোভকারী নিহত হন। এ নিয়ে দুই দিনের বিক্ষোভে অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছেন বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন কাঠমান্ডুর সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক মোহন রেগমি। আরও চার শতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।

গতকাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অলির সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট পাওদেল তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং পার্লামেন্টকে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানান। সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন নেপালভিত্তিক জননীতি বিশ্লেষক বিনয় মিশ্রা।

তবে নেপালের পার্লামেন্টে এখন কোনো দলের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই আইনপ্রণেতারা খুব সম্ভবত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে কারা থাকবেন, তা নিয়ে আলোচনায় জেন-জিদের প্রতিনিধিরাও থাকবেন বলে মনে করেন সহকারী অধ্যাপক মিশ্রা।